পার্শ্ব (পরিবর্তিনী) একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য - Parshwa/Paribortini Ekadashi
পার্শ্ব (পরিবর্তিনী) একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য
শায়িত ভগবান এই তিথিতে পার্শ্ব পরিবর্তন করেন। তাই এর নাম পার্শ্ব একাদশী বা পরিবর্তিনী একাদশী। যুধিষ্ঠির মহারাজ বললেন – হে জনার্দন! আপনার এসকল কথা শুনেও আমার সন্দেহ পূর্ণরূপে দূর হয়নি। হে দেব! আপনি কিভাবে শয়ন করেন, কিভাবেই বা পার্শ্ব পরিবর্তন করেন, আর চার্তুমাস্য ব্রত পালনকারীর কি কর্তব্য এবং আপনার শয়নকালে লোকের কি করণীয়? এসব বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আমাকে বলুন। আর কেনই বা দৈত্যরাজ বলিকে বেঁধে রাখা হয়েছিল, তা বর্ণনা করে আমার সকল সন্দেহ দূর করুন। শ্রীকৃষ্ণ বললেন – হে রাজন! দৈত্যকুলে আবির্ভূত প্রহ্লাদ মহারাজের পৌত্র 'বলি' আমার অতি প্রিয় ভক্ত ছিল। সে আমার সন্তুষ্টি বিধানের জন্য গো-ব্রাহ্মণ পূজা ও যজ্ঞাদি ব্রত সম্পাদন করত। কিন্তু ইন্দ্রের প্রতি বিদ্বেষবশত সকল দেবলোক সে জয় করে নেয়। তখন দেবতাগণসহ ইন্দ্র আমার শরণাপন্ন হয়েছিল। তাদের প্রার্থনায় আমি ব্রাহ্মণবালক বেশে বামনরূপে বলি মহারাজের যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হলাম।
তার কাছে আমি ত্রিপাদভূমিমাত্র প্রার্থনা করেছিলাম। সেই তুচ্ছ বস্তু থেকে আরও শ্রেষ্ঠ কিছু সে আমাকে দিতে চাইলেও আমি কেবল ত্রিপাদ ভূমি গ্রহণেই স্থির থাকলাম। দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য আমাকে ভগবানরূপে জানতে পেরে বলিমহারাজকে ঐ দান দিতে নিষেধ করল। কিন্তু সত্যাশ্রয়ী বলি গুরুর নির্দেশ অমান্য করে আমাকে দান দিতে সংকল্প করল। তখন আমি এক পদে নীচের সপ্তলোক, আরেক পদে উপরের সপ্তভুবন অধিকার করে নিলাম। পুনরায় তৃতীয় পদের স্থান চাইলে সে তার মাথা পেতে দিল। আমি তার মস্তকে তৃতীয় পদ স্থাপন করলাম। তার আচরণে সন্তুষ্ট হয়ে আমি সর্বদা তার কাছে বাস করার প্রতিশ্রুতি দিলাম। তার শুপক্ষীয়া একাদশীতে ভগবান শ্রীবামনদেবের এক মূর্তি বলি মহারাজের আশ্রমে স্থাপিত হয়।
দ্বিতীয় মূর্তি ক্ষীর সাগরে অনস্তদেবের কোলে শয়ন একাদশী থেকে উত্থান একাদশী পর্যন্ত চারমাস শয়ন অবস্থায় থাকেন। এই চারমাস যে ব্যক্তি নির্দিষ্ট নিয়ম, ব্রত বা জপ- তপ ব্যতীত দিনযাপন করে, সেই মহামূর্খ জীবিত থাকলেও তাকে মৃত বলে জানতে হবে। শ্রাবণ মাসে শাক, ভাদ্র মাসে দই, আশ্বিনে দুধ, কার্তিক মাসে মাসকলাই বর্জন করে এই চারমাস শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করতে হয়। প্রতিটি একাদশী ব্রত যথাযথ পালন করতে হয়। শায়িত ভগবান পার্শ্ব পরিবর্তন করেন বলে এই একাদশী মহাপুণ্য ও সকল অভীষ্ট প্রদাতা। এই একাদশী ব্রত পালনে এক সহস্র অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল পাওয়া যায়।
একাদশী পালনের নিয়মাবলী
ভোরে শয্যা ত্যাগ করে শুচিশুদ্ধ হয়ে শ্রীহরির মঙ্গল আরতিতে অংশগ্রহণ করতে হয়। শ্রীহরির পাদপদ্মে প্রার্থনা করতে হয়, “হে শ্রীকৃষ্ণ, আজ যেন এই মঙ্গলময়ী পবিত্র একাদশী সুন্দরভাবে পালন করতে পারি, আপনি আমাকে কৃপা করুন।” একাদশীতে গায়ে তেল মাখা, সাবান মাখা, পরনিন্দা-পরচর্চা, মিথ্যাভাষণ, ক্রোধ, দিবানিদ্রা, সাংসারিক আলাপাদি বর্জনীয়। এই দিন গঙ্গা আদি তীর্থে স্নান করতে হয়। মন্দির মার্জন, শ্রীহরির পূজার্চনা, স্তবস্তুতি, গীতা-ভাগবত পাঠ আলোচনায় বেশি করে সময় অতিবাহিত করতে হয়।
এই তিথিতে গোবিন্দের লীলা স্মরণ এবং তাঁর দিব্য নাম শ্রবণ করাই হচ্ছে সর্বোত্তম। শ্রীল প্রভুপাদ ভক্তদের একাদশীতে পঁশিচ মালা বা যথেষ্ট সময় পেলে আরো বেশি জপ করার নির্দেশ দিয়েছেন। একাদশীর দিন ক্ষৌরকর্মাদি নিষিদ্ধ। একাদশী ব্রত পালনে ধর্ম অর্থ, কাম, মোক্ষ আদি বহু অনিত্য ফলের উল্লেখ শাস্ত্রে থাকলেও শ্রীহরিভক্তি বা কৃষ্ণপ্রেম লাভই এই ব্রত পালনের মুখ্য উদ্দেশ্য। ভক্তগণ শ্রীহরির সন্তোষ বিধানের জন্যই এই ব্রত পালন করেন। পদ্মপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, বরাহপুরাণ, স্কন্দপুরাণ ও বৈষ্ণবস্মৃতিরাজ শ্রীহরিভক্তিবিলাস আদি গ্রন্থে এ সকল কথা বর্ণিত আছে।
বছরে ছাব্বিশটি একাদশী আসে। সাধারণত বার মাসে চব্বিশটি একাদশী। এইগুলি হচ্ছে-
১. উৎপন্না একাদশী ২. মোক্ষদা একাদশী
৩. সফলা একাদশী ৪. পুত্রদা একাদশী
৫. ষটতিলা একাদশী ৬. জয়া একাদশী
৭. বিজয়া একাদশী ৮. আমলকী একাদশী
৯. পাপমোচনী একাদশী ১০. কামদা একাদশী
১১. বরুথিনী একাদশী ১২. মোহিনী একাদশী
১৩. অপরা একাদশী ১৪. পাণ্ডবা নির্জলা একাদশী
১৫. যোগিনী একাদশী ১৬. শয়ন একাদশী
১৭. কামিকা একাদশী ১৮. পবিত্রারোপণী একাদশী
১৯. অন্নদা একাদশী ২০. পার্শ্ব (পরিবর্তিনী) একাদশী
২১. ইন্দিরা একাদশী ২২. পাশাঙ্কুশা (পাপাঙ্কুশা) একাদশী
২৩. রমা একাদশী ২৪. উত্থান একাদশী
কিন্তু যে বৎসর পুরুষোত্তমাস, অধিমাস বা মলমাস থাকে, সেই বৎসর পদ্মিনী ও পরমা নামে আরও দুটি একাদশীর আবির্ভাব হয়। যারা যথাবিধি একাদশী উপবাসে অসমর্থ অথবা ব্রতদিনে সাধুসঙ্গে হরিকথা শ্রবণে অসমর্থ, তারা এই একাদশী মাহাত্ম্য পাঠ বা শ্রবণ করলে অসীম সৌভাগ্যের অধিকারী হবেন।
Post a Comment