তৃতীয় অধ্যায় - কর্মযোগ
তৃতীয় অধ্যায়
ওঁ তৎ সৎ
শ্রীমদ্ভগবদ গীতা
ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়ঃ
তৃতীয় অধ্যায় - কর্মযোগ
শ্লোক:1:
অর্জুন উবাচঃ
জ্যায়সী চেৎ কর্মণস্তে মতা বুদ্ধির্জনার্দন ।
তৎ কিং কর্মণি ঘোরে মাং নিয়োজয়সি কেশব ॥১॥
শব্দার্থঃ অর্জুনঃ উবাচ –অর্জুন বললেন, জ্যায়সী—শ্রেয়তর; চেৎ — যদি কর্মণঃ–সকাম কর্ম অপেক্ষা; তে–তোমার, মতা — মতে, বুদ্ধিঃ - বুদ্ধি; জনার্দন – হে শ্রীকৃষ্ণ, তৎ—তা হলে; কিম্ - কেন, কর্মণি -কর্মে, ঘোরে - ভয়ানক, মাম্ - আমাকে, নিয়োজয়সি — নিযুক্ত করছ; কেশব – হে শ্রীকৃষ্ণ।
অনুবাদ:- অর্জুন বললেন-হে জনার্দন ! হে কেশব! যদি তোমার মতে কর্ম অপেক্ষা ভক্তি-বিষয়িনী বুদ্ধি শ্রেয়তর হয়, তা হলে এই ভয়ানক যুদ্ধে নিযুক্ত হওয়ার জন্য কেন আমাকে প্ররোচিত করছ?
শ্লোক:2:
ব্যামিশ্রেণেব বাক্যেন বুদ্ধিং মোহয়সীব মে ।
তদেকং বদ নিশ্চিত্য যেন শ্রেয়োহহমাপ্নুয়াম্ ॥২॥
শব্দার্থঃ ব্যামিশ্রেণ - স্বার্থবোধক, ইব—যেন; বাক্যেন— বাক্যের দ্বারা, বুদ্ধিম্ - বুদ্ধি, মোহয়সি— মোহিত করছ, ইব–মতো: মে – আমার, তৎ - অতএব, একম্ - একমাত্র; বদ – দয়া করে বল, নিশ্চিত্য—নিশ্চিতভাবে, যেন—যার দ্বারা, শ্রেয়ঃ —প্রকৃত কল্যাণ; অহম্ - আমি, আপ্নুয়াম্ – লাভ করতে পারি।
অনুবাদ:- তুমি যেন দ্ব্যর্থবোধক বাক্যের দ্বারা আমার বুদ্ধি বিভ্রান্ত করছ। তাই, দয়া করে আমাকে নিশ্চিতভাবে বল কোনটি আমার পক্ষে সবচেয়ে শ্রেয়স্কর।
শ্লোক:3:
শ্রীভগবানুবাচঃ
লোকেহস্মিন্ দ্বিবিধা নিষ্ঠা পুরা প্রোক্তা ময়ানঘ।
জ্ঞানযোগেন সাংখ্যানাং কর্মযোগেন যোগিনাম্ ॥৩॥
শব্দার্থঃ শ্রীভগবান উবাচ—পরমেশ্বর ভগবান বললেন; লোকে –জগতে, অস্মিন্—এই দ্বিবিধা—দুই প্রকার; নিষ্ঠা—নিষ্ঠা, পুরা— ইতিপূর্বে, প্রোক্তা—উক্ত হয়েছে; ময়া - আমার দ্বারা; অনঘ - হে নিষ্পাপ, জ্ঞানযোগেন—জ্ঞানযোগের দ্বারা, সাংখ্যানাম, — অভিজ্ঞতালব্ধ দার্শনিকদের কর্মযোগেন - ভগবানে অর্পিত নিষ্কাম কর্মযোগের দ্বারা; যোগিনাম–ভক্তদের।
অনুবাদ:- পরমেশ্বর ভগবান বললেন-হে নিষ্পাপ অর্জুন! আমি ইতিপূর্বে ব্যাখ্যা করেছি যে, দুই প্রকার মানুষ আত্ম-উপলব্ধি করতে চেষ্টা করে। কিছু লোক অভিজ্ঞতা লব্ধ দার্শনিক জ্ঞানের আলাচনার মাধ্যমে নিজেকে জানতে চান এবং অন্যেরা আবার তা ভক্তির মাধ্যমে জানতে চান।
শ্লোকঃ৪
ন কর্মণামনারম্ভান্ নৈষ্কর্ম্যং পুরুষোহশ্নুতে ।
ন চ সন্ন্যসনাদেব সিদ্ধিং সমধিগচ্ছতি ॥৪॥
শব্দার্থঃ ন—না: কর্মণাম্ - শাস্ত্রীয় কর্মের, অনারম্ভাৎ - অনুষ্ঠান না করে; নৈষ্কর্ম্যং - কর্মফল থেকে মুক্তি; পুরুষঃ—মানুষ, অশ্নুতে - লাভ করে, ন–না, চ–ও, সন্নাসনাৎ - কর্মত্যাগের দ্বারা; এব—কেবল; সিদ্ধিম্ — সাফল্য; সমধিগচ্ছতি - লাভ করে।
অনুবাদঃ- কেবল কর্মের অনুষ্ঠান না করার মাধ্যমে কর্মফল থেকে মুক্ত হওয়া যায় না, আবার কর্মত্যাগের মাধ্যমেও সিদ্ধি লাভ করা যায় না।
শ্লোক:5:
ন হি কশ্চিৎ ক্ষণমপি জাতু তিষ্টত্যকর্মকৃৎ ।
কার্যতে হ্যবশঃ কর্ম সর্বঃ প্রকৃতিজৈর্গুণৈঃ ॥৫॥
শব্দার্থ: ন–না: হি - অবশ্যই কশ্চিৎ—কেউ, ক্ষণম্ —ক্ষণ মাত্রও, অপি–ও; জাতু - কখনও, তিষ্ঠতি—থাকতে পারে, অকর্মকৃৎ - কর্ম না করে; কার্যতে - করতে বাধ্য হয়: হি–অবশ্যই, অবশঃ - অসহায়ভাবে, কর্ম-কর্ম, সর্বঃ—সকলে, প্রকৃতিজেঃ —প্রকৃতিজাত, গুণৈঃ– গুণসমূহের দ্বারা।
অনুবাদ:- সকলেই মায়াজাত গুণসমূহের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অসহায়ভাবে কর্ম করতে বাধ্য হয়; তাই কর্ম না করে কেউই ক্ষণকালও থাকতে পারে না।
শ্লোক:6:
কর্মেন্দ্রিয়াণি সংযম্য য আস্তে মনসা স্মরন্ ।
ইন্দ্রিয়ার্থান্ বিমুঢ়াত্মা মিথ্যাচারঃ স উচ্যতে ॥৬॥
শব্দার্থঃ কর্মেন্দ্রিয়াণি — পঞ্চা-কর্মেন্দ্রিয়; সংযম্য - সংযত করে; যঃ—যে; আস্তে - অবস্থান করে, মনসা - মনের দ্বারা, স্মরণ - স্মরণ করে; ইন্দ্রিয়ার্থান্ — ইন্দ্রিয়ের বিষয়সমূহ: বিমূঢ়–মূঢ়, আত্মা—আত্মা, মিথ্যাচারঃ—কপটাচার; সঃ—তাকে, উচ্যতে বলা হয়।
অনুবাদ:- যে ব্যক্তি পঞ্চ-কর্মেন্দ্রিয় সংযত করেও মনে মনে শব্দ, রস আদি ইন্দ্রিয়গুলি স্মরণ করে, সেই মুঢ় অবশ্যই নিজেকে বিভ্রান্ত করে এবং তাকে মিথ্যাচারী ভণ্ড বলা হয়ে থাকে।
শ্লোক:7:
যস্ত্বিন্দ্রিয়াণি মনসা নিয়ম্যারভতেহর্জুন ।
কর্মেন্দ্রিয়ৈঃ কর্মযোগমসক্তঃ সঃ বিশিষ্যতে ॥৭॥
শব্দার্থ: যঃ—যিনি; তু—কিন্তু; ইন্দ্রিয়াণি—ইন্দ্রিয়সমূহঃ, মনসা - মনের দ্বারা, নিয়ম্য - সংযত করে, আরভতে - আরম্ভ করেন, অর্জুন - হে অর্জুন, কর্মেন্দ্রিয়ৈঃ - কর্মেন্দ্রিয়ের দ্বারা, কর্মযোগম্ - কর্মযোগ, অসক্তঃ — আসক্তি রহিত, সঃ– তিনি বিশিষ্যতে – বিশিষ্ট হন।
অনুবাদ:- কিন্তু যিনি মনের দ্বারা ইন্দ্রিয়গুলিকে সংযত করে অনাসক্তভাবে কর্মযোগের অনুষ্ঠান করেন, তিনি পূর্বোক্ত মিথ্যাচারী অপেক্ষা অনেক গুণে শ্রেষ্ঠ।
শ্লোক:8:
নিয়তং কুরু কর্ম ত্বং কর্ম জ্যায়ো হ্যকর্মণঃ ।
শরীরযাত্রাপি চ তে ন প্রসিদ্ধ্যেদকর্মণ ॥৮॥
শব্দার্থঃ নিয়তম্ – শাস্ত্রোক্ত, কুরু - কর, কর্ম-কর্ম, ত্বম্ – তুমি, কর্ম–কাজ, জ্যায়ঃ - শ্রেয়: হি—অবশ্যই; অকর্মণঃ - কর্মত্যাগ অপেক্ষা; শরীরযাত্রা - দেহধারণ; অপি— এমন কি, চ–ও; তে—তোমার; ন-না: প্রসিদ্ধ্যেৎ— সিদ্ধ হয়, অকর্মণঃ - কর্ম না করে।
অনুবাদ:- তুমি শাস্ত্রক্তো কর্মের অনুষ্ঠান কর, কেন না কর্মত্যাগ থেকে কর্মের অনুষ্ঠান শ্রেয়। কর্ম না করে কেউ দেহযাত্রাও নির্বাহ করতে পারে না।
শ্লোক:9:
যজ্ঞার্থাৎ কর্মণোহন্যত্র লোকোহয়ং কর্মবন্ধনঃ।
তদর্থং কর্ম কৌন্তেয় মুক্তসঙ্গঃ সমাচর ॥৯॥
শব্দার্থঃ যজ্ঞার্থাৎ- যজ্ঞ বা বিষ্ণুর জন্যই কেবল; কর্মণঃ—কর্ম: অন্যত্র - তা ছাড়া, লোকঃ —এই জগতে, অয়ম্ - এই, কর্মবন্ধনঃ - কর্মবন্ধন: তৎ - তার, অর্থম - নিমিত্ত, কর্ম - কর্ম, কৌন্তেয় – হে কুন্তীপুত্র, মুক্তসঙ্গঃ—আসক্তি রহিত হয়ে, সমাচর - অনুষ্ঠান কর।
অনুবাদ:- বিষ্ণুর প্রীতি সম্পাদন করার জন্য কর্ম করা উচিত; তা না হলে কর্মই এই জড় জগতে বন্ধনের কারণ। তাই, হে কৌন্তেয়! ভগবানের সন্তুষ্টি বিধানের জন্যই কেবল তুমি তোমার কর্তব্যকর্ম অনুষ্ঠান কর এবং এভাবেই তুমি সর্বদাই বন্ধন থেকে মুক্ত থাকতে পারবে।
শ্লোক:10:
সহযজ্ঞাঃ প্রজাঃ সৃষ্ট্বা পুরোবাচ প্রজাপতিঃ ।
অনেন প্রসবিষ্যধ্বমেষ বোহস্ত্বিষ্টকামধুক্ ॥১০॥
শব্দার্থঃ সহ–সহ, যজ্ঞাঃ — যজ্ঞাদি, প্রজাঃ —প্রজাসকল, সৃষ্ট্বা—সৃষ্টি করে; পুরা— পুরাকালে; উবাচ — বলেছিলেন, প্রজাপতিঃ—সৃষ্টিকর্তা; অনেন–এর দ্বারা, প্রসবিষ্যধ্বম্ - উত্তরোত্তর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হও; এবঃ—এই সকল; বঃ— তোমাদের, অস্তু — হোক, ইষ্ট—সমস্ত অভীষ্ট, কামধুক—প্রদানকারী।
অনুবাদ:- সৃষ্টির প্রারম্ভে সৃষ্টিকর্তা যজ্ঞাদি সহ প্রজাসকল সৃষ্টি করে বলেছিলেন- "এই যজ্ঞের দ্বারা তোমরা উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ হও৷ এই যজ্ঞ তোমাদের সমস্ত অভীষ্ট পূর্ণ করবে।"
শ্লোক:11:
দেবান্ ভাবয়তানেন তে দেবা ভাবয়ন্ত্ত বঃ ।
পরস্পরং ভাবয়ন্তঃ শ্রেয়ঃ পরমবাপ্স্যথ ॥১১॥
শব্দার্থঃ দেবান–দেবতারা; ভাবয়ত —সন্তুষ্ট হয়ে, অনেন—এই যজ্ঞের দ্বারা; তে — সেই, দেবাঃ—দেবতারা; ভাবমন্ত্র—প্রীতি সাধন করবেন, বঃ— তোমাদের, পরস্পরম্ - পরস্পর; ভাৰয়ন্তঃ — প্রীতি সাধন করে, শ্রেয়ঃ —মঙ্গল, পরম্ — পরম; অবাপ্স্যথ— লাভ করবে।
অনুবাদ:- তোমাদের যজ্ঞ অনুষ্ঠানে প্রীত হয়ে দেবতারা তোমাদের প্রীতি সাধন করবেন। এভাবেই পরস্পরের প্রীতি সম্পাদন করার মাধ্যমে তোমরা পরম মঙ্গল লাভ করবে।
শ্লোক:12:
ইষ্টান্ ভোগান্ হি বো দেবা দাস্যন্তে যজ্ঞভাবিতাঃ ।
তৈর্দত্তানপ্রদায়ৈভ্যো যো ভুঙক্তে স্তেন এব সঃ ॥১২॥
শব্দার্থঃ ইষ্টান্ — বাঞ্ছিত; ভোগান—ভোগ্যবস্তু, হি—অবশ্যই; বঃ—তোমাদের, দেবাঃ - দেবতারা; দাস্যন্তে - দান করবেন, যজ্ঞভাবিতাঃ - যজ্ঞ অনুষ্ঠানের কলে সন্তুষ্ট হয়ে, তৈঃ—তাদের দ্বারা, দত্তান্ - প্রদত্ত বস্তুসকল; অপ্রদায় - নিবেদন না করে, এভ্যঃ —দেবতাদেরকে, যঃ—যে, ভুঙক্তে—ভোগ করে, স্তেনঃ—চোর; এব—অবশ্যই; সঃ - সেই
অনুবাদ:- যজ্ঞের ফলে সন্তুষ্ট হয়ে দেবতারা তোমাদের বাঞ্ছিত ভোগ্যবস্তু প্রদান করবেন। কিন্তু দেবতাদের প্রদত্ত বস্তু তাঁদের নিবেদন না করে যে ভোগ করে, সে নিশ্চয়ই চোর।
শ্লোক:13:
যজ্ঞশিষ্টাশিনঃ সন্তো মুচ্যন্তে সর্বকিল্বিষৈঃ ।
ভুঞ্জতে তে ত্বঘং পাপা যে পচন্ত্যাত্মকারণাৎ ॥১৩॥
শব্দার্থঃ যজ্ঞশিষ্ট - যজ্ঞাবশেষ; অশিন: - ভোজনকারী, সন্ত - ভক্তগণ, মুচ্যন্তে - মুক্ত হন, সর্ব—সর্ব প্রকার, কিল্বিষৈঃ—পাপ থেকে, ভূঞ্জতে — ভোগ করে, তে - তারা, তু – কিন্তু; অঘম্ - পাপ, পাপাঃ- পাপীরা, যে - যারা, পচন্তি–পাক করে, আত্মকারণাৎ - নিজের জন্য।
অনুবাদ:- ভগবাদ্ভক্তেরা সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হন, কারণ তাঁরা যজ্ঞাবশিষ্ট অন্নাদি গ্রহন করেন। যারা কেবল স্বার্থপর হয়ে নিজেদের ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তির জন্য অন্নাদি পাক করে, তারা কেবল পাপই ভোজন করে।
শ্লোক:14:
অন্নাদ্ ভবন্তি ভূতানি পর্জন্যাদন্নসম্ভবঃ ।
যজ্ঞাদ্ ভবতি পর্জন্যো যজ্ঞঃ কর্মসমুদ্ভবঃ ॥১৪॥
শব্দার্থঃ অন্নাৎ—অন্ন থেকে, ভবন্তি—উৎপন্ন হয়; ভূতানি—জড় দেহ; পর্জন্যাৎ - বৃষ্টি থেকে, অন্ন - অন্ন, সম্ভবঃ- উৎপন্ন হয়, যজ্ঞাৎ - যজ্ঞ থেকে, ভবতি - সম্ভব হয়; পর্জন্যঃ - বৃষ্টি; যজ্ঞ - যজ্ঞ অনুষ্ঠান, কর্ম - শাস্ত্রোক্ত কর্ম: সমুদ্ভবঃ – উদ্ভব হয়।
অনুবাদ:- অন্ন খেয়ে প্রাণীগণ জীবন ধারণ করে৷ বৃষ্টি হওয়ার ফলে অন্ন উৎপন্ন হয় ৷ যজ্ঞ অনুষ্ঠান করার ফলে বৃষ্টি উৎপন্ন হয় এবং শাস্ত্রোক্ত কর্ম থেকে যজ্ঞ উৎপন্ন হয়।
শ্লোক:15:
কর্ম ব্রহ্মোদ্ভবং বিদ্ধি ব্রহ্মাক্ষরসমুদ্ভবম্ ।
তস্মাৎ সর্বগতং ব্রহ্ম নিত্যং যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিতম্ ॥১৫॥
শব্দার্থঃ কর্ম–কর্ম; ব্রহ্ম—বেদ থেকে, উদ্ভবম্ – উদ্ভূত; বিদ্ধি—জানবে; ব্রহ্ম – বেদ, অক্ষর – পরব্রহ্মা (পরমেশ্বর ভগবান) থেকে, সমুদ্ভম্— সম্যকরূপে উদ্ভুত, তষ্মাৎ - অতএব; সর্বগতম - সর্বব্যাপক, ব্রহ্ম - ব্রহ্ম; নিত্যম—নিত্য, যজ্ঞে - যজ্ঞে, প্রতিষ্ঠিতম্—প্রতিষ্ঠিত।
অনুবাদ:- যজ্ঞাদি কর্ম বেদ থেকে উদ্ভূত হয়েছে এবং বেদ অক্ষর বা পরমেশ্বর ভগবান থেকে প্রকাশিত হয়েছে। অতএব সর্বব্যাপক ব্রহ্ম সর্বদা যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত আছেন।
শ্লোক:16:
এবং প্রবর্তিতং চক্রং নানুবর্তয়তীহ যঃ ।
অঘায়ুরিন্দ্রিয়ারামো মোঘং পার্থ স জীবতি ॥১৬॥
শব্দার্থঃ এবম্ – এই প্রকারে, প্রবর্তিতম্ [-বেদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত; চক্রম - চক্র; ন – করে না, অনুবর্তয়তি–গ্রহণ, ইহ–এই জীবনে, যঃ—যিনি, অঘায়ুঃ—পাপপূর্ণ জীবন, ইন্দ্রিয়ারামঃ–ইন্দ্রিয়াসক্ত, মোঘম্ - বৃথা, পার্থ-হে পৃথাপুত্র (অর্জুন), সঃ– সেই ব্যক্তি, জীবতি—জীবন ধারণ করে।
অনুবাদ:- হে অর্জুন ! যে ব্যক্তি এই জীবনে বেদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত যজ্ঞ অনুষ্ঠানের পন্থা অনুসরণ করে না, সেই ইন্দ্রিয়সুখ-পরায়ণ পাপী ব্যক্তি বৃথা জীবন ধারণ করে।
শ্লোক:17:
যস্ত্বাত্মরতিরেব স্যাদাত্মতৃপ্তশ্চ মানবঃ ।
আত্মন্যেব চ সন্ত্তষ্টস্তস্য কার্যং ন বিদ্যতে ॥১৭॥
শব্দার্থঃ যঃ- যে; তু—কিন্তু, আত্মরতিঃ—আত্মারাম, এব–অবশ্যই, স্যাৎ - থাকেন, আত্মতৃপ্ত - আত্মতৃপ্ত; চ–এবং, মানবঃ—মানুষ; আত্মনি—আত্মাতে, এব–কেবল; চ–এবং, সন্তুষ্টঃ— সহষ্ট, তা - তাঁর, কার্যম্ - কর্তব্যকর্ম; ন-নেই; বিদ্যতে - বিদ্যমান।
অনুবাদ:-কিন্তু যে ব্যক্তি আত্মাতেই প্রীত, আত্মাতেই তৃপ্ত আত্মাতেই সন্তুষ্ট, তাঁর কোন কর্তব্যকর্ম নেই।
শ্লোক:18:
নৈব তস্য কৃতেনার্থো নাকৃতেনেহ কশ্চন ।
ন চাস্য সর্বভূতেষু কশ্চিদর্থব্যপাশ্রয়ঃ ॥১৮॥
শব্দার্থঃ ন—নেই; এব—অবশ্যই; তস্য—তাঁর, কৃতেন - কর্তব্যকর্ম অনুষ্ঠানের দ্বারা, অর্থঃ —প্রয়োজন; ন–নেই; অকৃতেন— কর্তব্যকর্ম না করলেও; ইহ—এই জগতে, কশ্চন—কোন কারণ, ন–নেই, চ–ও, অস্য—এ, সর্বভূতেষু—সমস্ত প্রাণীর মধ্যে; কশ্চিৎ—কেউই; অর্থ—প্রয়োজন; ব্যপাশ্রয়ঃ — আশ্রয় গ্রহণ।
অনুবাদ:- আত্মনন্দ অনুভবকারী ব্যক্তির এই জগতে ধর্ম অনুষ্ঠানের কোন প্রয়োজন নেই এবং এই প্রকার কর্ম না করারও কোন কারণ নেই। তাকে অন্য কোন প্রাণীর উপর নির্ভর করতেও হয় না।
শ্লোক:19:
তস্মাদসক্তঃ সততং কার্যং কর্ম সমাচর ।
অসক্তো হ্যাচরন্ কর্ম পরমাপ্নোতি পুরুষঃ॥১৯॥
শব্দার্থঃ তস্মাৎ—অতএব, অসক্তঃ — আসক্তি রহিত হয়ে, সততম্ - সর্বদা, কার্যম্ - কর্তব্য, কর্ম - কর্ম, সমাচর - অনুষ্ঠান কর, অসক্ত - অনাসক্ত হয়ে, হি–অবশ্যই, আচরন - অনুষ্ঠান করলে, কর্ম-কর্ম, পরম্ - পরতত্ত্ব, আপ্নোতি - প্রাপ্ত হয়, পুরুষঃ — মানুষ।
অনুবাদ:- অতএব, কর্মফলের প্রতি আসক্তি রহিত হয়ে কর্তব্যকর্ম সম্পাদন কর৷ অনাসক্ত হয়ে কর্ম করার ফলেই মানুষ পরতত্ত্বকে লাভ করতে পারে ৷
শ্লোক:20:
কর্মণৈব হি সংসিদ্ধিমাস্থিতা জনকাদয়ঃ ।
লোকসংগ্রহমেবাপি সংপশ্যন্ কর্তুমর্হসি॥২০॥
শব্দার্থঃ কর্মণা - কর্মের দ্বারা; এর—কেবল; হি–অবশ্যই; সংসিদ্ধিম—সিদ্ধি; আস্থিতাঃ প্রাপ্ত হয়েছিলেন, জনকাদয়ঃ—জনক আদি রাজারা, লোকসংগ্রহম্ - জনসাধারণকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য; এব অপি - ও; সংপশ্যন্ - বিবেচনা করে, কর্তুম্ - কর্ম করা; অর্হসি—উচিত।
অনুবাদ:- জনক আদি রাজারাও কর্ম দ্বারাই সংসিদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছিলেন৷ অতএব, জনসাধারণকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য তোমার কর্ম করা উচিত।
শ্লোক:21:
যদ্ যদাচরতি শ্রেষ্ঠস্তত্তদেবেতরো জনঃ ।
স যৎ প্রমাণং কুরুতে লোকস্তদনুবর্ততে ॥২১॥
শব্দার্থঃ যৎ যৎ -যেভাবে যেভাবে, আচরতি — আচরণ করেন; শ্রেষ্ঠঃ - শ্রেষ্ঠ বাক্তি, তৎ তৎ–সেই সেভাবেই; এব–অবশ্যই; ইতরঃ—সাধারণ, জনঃ - মানুষ, সঃ—তিনি, যৎ - যা, প্রমাণম্ - প্ৰমাণ; কুরুতে - স্বীকার করেন, লোকঃ - সারা পৃথিবী; তত্ - তা, অনুবর্ততে - অনুসরণ করে।
অনুবাদ:- শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি যে ভাবে আচরণ করেন, সাধারণ মানুষেরা তার অনুকরণ করে। তিনি যা প্রমাণ বলে স্বীকার করেন, সমগ্র পৃথিবী তারই অনুসরণ করে।
শ্লোক:22:
ন মে পার্থাস্তি কর্তব্যং ত্রিষু লোকেষু কিঞ্চন।
নানবাপ্তমবাপ্তব্যং বর্ত এব চ কর্মণি ॥২২॥
শব্দার্থঃ ন–না, মে - আমার; পার্থ-হে পৃথাপুত্র, অস্তি —আছে, কর্তব্যম্ - কর্তব্য; ত্রিষু–তিন; লোকেষু— জগতে; কিঞ্চন— কোন; ন–না; অনব্যপ্তম্ – অপ্রাপ্ত, অবাপ্তব্যম্ - প্রাপ্তব্য; বর্তে - যুক্ত আছি, এব–অবশ্যই, চ–ও; কর্মণি - শাস্ত্রোক্ত কর্মে।
অনুবাদ:- হে পার্থ ! এই ত্রিজগতে আমার কিছুই কর্তব্য নেই। আমার অপ্রাপ্ত কিছু নেই এবং প্রাপ্তব্যও কিছু নেই৷ তবুও আমি কর্মে ব্যাপৃত আছি।
শ্লোক:23:
যদি হ্যহং ন বর্তেয়ং জাতু কর্মণ্যতন্দ্রিতঃ ।
মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ ॥২৩॥
শব্দার্থঃ যদি—যদি, হি–অবশ্যই, অহম্ – আমি; ন–না, বর্তেয়ম - প্রবৃত্ত হই, জাতু— কখনও; কর্মণি— শাস্ত্রোক্ত কর্মে, অতন্ত্রিতঃ — অনলস হয়ে, মম - আমার; বর্ত্ম - পথ, অনুবর্তন্তে— অনুসরণ করবে; মনুষ্যাঃ—সমস্ত মানুষ; পার্থ-হে পৃথাপুত্র, সর্বশঃ—সর্বতোভাবে।
অনুবাদ:- হে পার্থ! আমি যদি অনলস হয়ে কর্তব্যকর্মে প্রবৃত্ত না হই, তবে আমার অনুবর্তী হয়ে সমস্ত মানুষই কর্ম ত্যাগ করবে।
শ্লোক:24:
উৎসীদেয়ুরিমে লোকা ন কুর্যাং কর্ম চেদহম্॥
সঙ্করস্য চ কর্তা স্যামুপহন্যামিমাঃ প্রজাঃ ॥২৪॥
শব্দার্থঃ উত্সীদেয়ুঃ—উৎসন্ন হবে; ইমে—এই সমস্ত, লোকাঃ- সমস্ত লোক, ন - না, কুর্যাম্ - করি; কর্ম - শাস্তোক্ত কর্ম, চেৎ - যদি, অহম্ – আমি, সঙ্করস্য - বর্ণসঙ্করের, চ–এবং, কর্তা - কর্তা, স্যাম্ – হব, উপহন্যাম্ —বিনষ্ট হবে, ইমাঃ ----এই সমস্ত, প্রজা-জীব
অনুবাদ:- আমি যদি কর্ম না করি, তা হলে এই সমস্ত লোক উৎসন্ন হবে। আমি বর্ণসঙ্কর সৃষ্টির কারণ হব এবং তার ফলে আমার দ্বারা সমস্ত প্রজা হবে।
শ্লোক:25:
সক্তাঃ কর্মণ্যবিদ্বাংসো যথা কুর্বন্তি ভারত।
কুর্যাদ্ বিদ্বাংস্তথাসক্তশ্চিকীর্ষুর্লোকসংগ্রহম্ ॥২৫॥
শব্দার্থঃ সক্তা:- আসক্ত হয়ে; কর্মণি – শাস্ত্রোক্ত কর্মে; অবিদ্বাংসঃ- অজ্ঞান মানুষেরা, যথা— যেমন; কুর্বন্তি করে, ভারত-হে ভরতবংশীয়; কুর্যাৎ - কর্ম করবেন; বিষয়- জ্ঞানী ব্যক্তি তথা-তেমন, অসক্তঃ—আসক্তি রহিত হয়ে; চিকীর্ষুঃ - পরিচালিত করতে ইচ্ছা করে, লোকসংগ্রহম্ - জনসাধারণকে।
অনুবাদ:- হে ভারত ! অজ্ঞানীরা যেমন কর্মফলের প্রতি আসক্ত হয়ে তাদের কর্তব্যকর্ম করে, তেমনই জ্ঞানীরা অনাসক্ত হয়ে, মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য কর্ম করবেন।
শ্লোক:26:
ন বুদ্ধিভেদং জনয়েদজ্ঞানাং কর্মসঙ্গিনাম্ ।
জোষয়েৎ সর্বকর্মাণি বিদ্বান্ যুক্তঃ সমাচরন্ ॥২৬॥
শব্দার্থঃ ন—নয়, বুদ্ধিভেদম—বুদ্ধিভ্রষ্ট, জনয়েৎ—জন্মানো উচিত; অজ্ঞানাম—অজ্ঞ ব্যক্তিদের কর্মসঙ্গিনাম-কর্মফলের প্রতি আসক্ত, জোষয়েৎ—নিযুক্ত করা উচিত, সর্ব—সমস্ত; কর্মাণি - কর্ম, বিদ্বান্ - জ্ঞানবান, যুক্তঃ – যুক্ত হয়ে, সমাচরন্ - অনুষ্ঠান করে।
অনুবাদ:- জ্ঞানবান ব্যক্তিরা কর্মাসক্ত জ্ঞানহীন ব্যক্তিদের বুদ্ধি বিভ্রান্ত করবেন না। বরং, তাঁরা ভক্তিযুক্ত চিত্তে সমস্ত কর্ম অনুষ্ঠান করে জ্ঞানহীন ব্যক্তিদের কর্মে প্রবৃত্ত করবেন।
শ্লোক:27:
প্রকৃতেঃ ক্রিয়মাণানি গুণৈঃ কর্মাণি সর্বশঃ ।
অহঙ্কারবিমূঢ়াত্মা কর্তাহমিতি মন্যতে ॥২৭॥
শব্দার্থঃ প্রকৃতেঃ—জড়া প্রকৃতির, ক্রিয়মাণানি—ক্রিয়মাণ, গুণৈঃ-গুণের দ্বারা; কর্মাণি - সমস্ত কর্ম; সর্বশঃ—সর্বপ্রকার; অহঙ্কার-বিমূঢ় - অহংকারের দ্বারা মোহাচ্ছন, আত্মা - আত্মা, কর্তা – কর্তা, অহম্ - আমি; ইতি—এভাবে, মনতে — মনে করে।
অনুবাদ:- অন্ধকারে মোহাচ্ছন্ন জীব জড়া প্রকৃতির ত্রিগুণ দ্বারা ক্রিয়মাণ সমস্ত কার্যকে স্বীয় কার্য বলে মনে করে 'আমি কর্তা'- এই রকম অভিমান করে।
শ্লোক:28:
তত্ত্ববিত্তু মহাবাহো গুণকর্মবিভাগয়োঃ ।
গুণা গুণেষু বর্তন্ত ইতি মত্বা ন সজ্জতে ॥২৮॥
শব্দার্থঃ তত্ত্ববিৎ-তত্ত্ব, তু– কিন্তু, মহাৰাহো - হে মহাবীর, গুণকর্ম—প্রকৃতির প্রভাব জনিত কৰ্ম, বিভাগয়োঃ—পার্থক্য, গুণাঃ—ইন্দ্রিয়সমূহঃ, গুণেষু – ইন্দ্রিয়-তর্পণে; বর্তন্তে—প্রবৃত্ত হন, ইতি—এভাবে, মত্বা - মনে করে, ন–নাঃ, সজ্জতে - আসক্ত হন।
অনুবাদ:- হে মহাবাহো ! তত্বজ্ঞ ব্যক্তি ভগবদ্ভক্তিমুখী কর্ম ও সকাম কর্মের পার্থক্য ভালভাবে অবগত হয়ে, কখনও ইন্দ্রিয়সুখ ভোগাত্মক কার্যে প্রবৃত্ত হন না।
শ্লোক:29:
প্রকৃতের্গুণসংমূঢ়া সজ্জন্তে গুণকর্মসু ।
তানকৃৎস্নবিদো মন্দান্ কৃৎস্নবিন্ন বিচালয়েৎ ॥২৯॥
শব্দার্থঃ প্রকৃতেঃ—জড়া প্রকৃতির; গুণসংমূঢ়াঃ - গুণের প্রভাবে বিমূঢ় ব্যক্তিরা; সজ্জন্তে - প্রযুক্ত হয়, গুণকর্মসু—প্রাকৃত কার্যকলাপে, তান্ — সেই সকল, অকৃৎস্নবিদঃ– অল্পজ্ঞ বাক্তিগণ, মন্দানং – মন্দবুদ্ধি, কৃৎস্নবিৎ-তত্ত্বজ্ঞ; ন-না, বিচালয়েৎ— বিচলিত করেন।
অনুবাদ:- জড়া প্রকৃতির গুণের দ্বারা মোহাচ্ছন্ন হয়ে, অজ্ঞান ব্যক্তিরা জাগতিক কার্যকলাপে প্রবৃত্ত হয়। কিন্তু তাদের কর্ম নিকৃষ্ট হলেও তত্বজ্ঞানী পুরুষেরা সেই মন্দবুদ্ধি ও অল্পজ্ঞ ব্যক্তিগণকে বিচলিত করেন না।
শ্লোক:30:
ময়ি সর্বাণি কর্মাণি সংন্যস্যাধ্যাত্মচেতসা।
নিরাশীর্নির্মমো ভূত্বা যুধ্যস্ব বিগতজ্বরঃ ॥৩০॥
শব্দার্থঃ ময়ি— আমাকে; সর্বাণি - সর্বপ্রকার, কর্মাণি - কর্ম, সন্যস্য—সমর্পণ করে; অধ্যাত্ম - আত্মনিষ্ঠ, চেতসা - চেতনার দ্বারা, নিরাশীঃ - নিষ্কাম; নির্মম - মমতাশূন্য; ভূত্বা – হয়ে, যুধ্যস্ব - যুদ্ধ কর, বিগতজ্বরঃ — শোকশুন্য হয়ে।
অনুবাদ:-অতএব, হে অর্জুন ! আধ্যাত্মচেতনা- সম্পন্ন হয়ে তোমার সমস্ত কর্ম আমাকে সমর্পণ কর এবং মমতাশুন্য, নিষ্কাম ও শোকশূন্য হয়ে তুমি যুদ্ধ কর।
শ্লোকঃ ৩১
যে মে মতমিদং নিত্যমনুতিষ্ঠন্তি মানবাঃ ।
শ্রদ্ধাবন্তোহনসূয়ন্তো মুচ্যন্তে তেহপি কর্মভিঃ ॥৩১॥
শব্দার্থঃ যে—যারা, মে—আমার, মতম্-নির্দেশাবলী, ইদম—এই, নিত্যম্ — সর্বদা, অনুতিষ্ঠন্তি – নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠান করেন; মানবাঃ - মানুষেরা। শ্রদ্ধাবন্তঃ - শ্রদ্ধাবান, অনসূয়ন্তঃ – মাৎসর্য রহিত, মুচ্যন্তে — মুক্ত হন, তে - তাঁরা সকলে, অপি—এমন কি, কর্মভিঃ - কর্মের বন্ধন থেকে।৷৩১৷৷
অনুবাদঃ আমার নির্দেশ অনুসারে যে-সমস্ত মানুষ তাঁদের কর্তব্যকর্ম অনুষ্ঠান করেন এবং যাঁরা শ্রদ্ধাবান ও মাৎসর্য রহিত হয়ে এই উপদেশ অনুসরণ করেন, তাঁরাও কর্মবন্ধন থেকে মুক্ত হন।
শ্লোক:32:
যে ত্বেতদভ্যসূয়ন্তো নানুতিষ্ঠন্তি মে মতম্ ।
সর্বজ্ঞানবিমূঢ়াংস্তান্ বিদ্ধি নষ্টানচেতসঃ ॥৩২॥
শব্দার্থঃ যে— যারা, তু–কিন্তু, এতৎ-এই, অভ্যসূয়ন্তঃ— মাৎসর্যবশতঃ, ন - না, অনুতিষ্ঠন্তি – নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠান করে, মে—আমার, মতম্-নির্দেশ, সর্বজ্ঞান - সর্বপ্রকার জ্ঞানে, বিমূঢ়ান-বিমূঢ়: তান — তাদেরকে, বিদ্ধি —জানবে, নষ্টান—বিনষ্ট, অচেতসঃ ঘ– কৃষ্ণভক্তিহীন।
অনুবাদ:- কিন্ত যারা অসূয়াপূর্বক আমার এই উপদেশ পালন করে না, তাদেরকে সমস্ত জ্ঞান থেকে বঞ্চিত, বিমূঢ় এবং পরমার্থ লাভের সকল প্রচেষ্টা থেকে ভ্রষ্ট বলে জানবে।
শ্লোক:33:
সদৃশং চেষ্টতে স্বস্যাঃ প্রকৃতের্জ্ঞানবানপি।
প্রকৃতিং যান্তি ভূতানি নিগ্রহঃ কিং করিষ্যতি ॥৩৩॥
শব্দার্থঃ সদৃশম্ — অনুরূপভাবে; চেষ্টতে - চেষ্টা করে; স্বস্যাঃ— স্বীয়, প্রকৃতেঃ—প্রকৃতির, জ্ঞানবান্— জ্ঞানবান: অপি—যদিও, প্রকৃতিম্ — স্বভাবকে, যান্তি - অনুগমন করেন, ভূতানি— সমস্ত জীব; নিগ্রহঃ – দমন, কিম্ – কিন্তু, করিষ্যতি - করতে পারে।
অনুবাদ:- জ্ঞানবান ব্যক্তিও তাঁর স্বভাব অনুসারে কার্য করেন, কারণ প্রত্যকেই ত্রিগুণজাত তাঁর স্বীয় স্বভাবকে অনুগমন করেন। সুতরাং নিগ্রহ করে কি লাভ হবে ?
শ্লোক:34:
ইন্দ্রিয়স্যেন্দ্রিয়স্যার্থে রাগদ্বেষৌ ব্যবস্থিতৌ ।
তয়োর্ন বশমাগচ্ছেৎ তৌ হ্যস্য পরিপন্থিনৌ ॥৩৪॥
শব্দার্থঃ ইন্দ্রিয়স্য — সমস্ত ইন্দ্রিয়ের; ইন্দ্রিয়স্য অর্থে— ইন্দ্রিয়-বিষয়সমূহে; রাগ-আসক্তি, দ্বেষৌ—বিদ্বেষ, ব্যবস্থিতৌ—বিশেষভাবে অবস্থিত; তয়োঃ — তাদের, ন - নয়, বশম্ — বশীভূত; আগচ্ছেৎ - হওয়া উচিত, তৌ—তাদের, হি–অবশ্যই, অস্য - তার, পরিপন্থিনৌ - প্রতিবন্ধক।
অনুবাদ:- সমস্ত জীবই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুতে আসক্তি অথবা বিরক্তি অনুভব করে, কিন্তু এভাবে ইন্দ্রিয় ও ইন্দ্রিয়ের বিষয়ের বশীভূত হওয়া উচিত নয়, কারণ তা পারমার্থিক প্রগতির পথে প্রতিবন্ধক।
শ্লোক:35:
শ্রেয়ান্ স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ।
স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ ॥৩৫॥
শব্দার্থঃ শ্রেয়ান - শ্রেষ্ঠ, স্বধর্মঃ - স্বধর্ম, বিগুণঃ – দোষযুক্ত, পরধর্মাৎ - অন্যের জন্য নির্দিষ্ট জন থেকে, স্বনুষ্ঠিতাৎ — উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত, স্বধর্মে - স্বধর্মে, নিধনম্ - নিধন, শ্রেয়ঃ - ভাল, পরধর্মঃ - অন্যের ধর্ম, ভয়াবহঃ – বিপজ্জনক।
অনুবাদ:- স্বধর্মের অনুষ্ঠান দোষযুক্ত হলেও উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত পরধর্ম থেকে উৎকৃষ্ট। স্বধর্ম সাধনে যদি মৃত্যু হয়, তাও মঙ্গলজনক, কিন্তু অন্যের ধর্মের অনুষ্ঠান করা বিপজ্জনক।
শ্লোক:36:
অর্জুন উবাচঃ
অথ কেন প্রযুক্তোহয়ং পাপং চরতি পুরুষঃ ।
অনিচ্ছন্নপি বার্ষ্ণেয় বলাদিব নিয়োজিতঃ ॥৩৬॥
শব্দার্থঃ অর্জুনঃ উবাচ—অর্জুন বললেন; অথ - তবে, কেন - কার দ্বারা, প্রযুক্তঃ — প্রেরিত হয়ে, অয়ম্ – এই, পাপম্ - পাপ, চরতি - আচরণ করে, পুরুষঃ—মানুষ, অনিচ্ছন্ — অনিচ্ছায়; অপি—যদিও, বার্ষ্ণেয় – হে বৃষ্ণি-বংশাবতংশ, বলাৎ - বলপূর্বক ইব – যেন, নিয়োজিতঃ – নিয়োজিত।
অনুবাদ:- অর্জুন বললেন- হে বার্ঞ্চেয়! মানুষ কার দ্বারা চালিত হয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেন বলপূর্বক নিয়োজিত হয়েই পাপাচরণে প্রবৃত্ত হয়?
শ্লোক:37:
শ্রীভগবানুবাচঃ
কাম এষ ক্রোধ এষ রজোগুণসমুদ্ভবঃ ।
মহাশনো মহাপাপ্মা বিদ্ধ্যেনমিহ বৈরিণম্ ॥৩৭॥
শব্দার্থঃ শ্রীভগবান উবাচ—পরমেশ্বর ভগবান বললেন; কামঃ-কাম, এষঃ - এই, ক্রোধঃ --ক্রোধ; এবঃ—এই, রজোগুণ - রজোগুণ: সমুদ্ভবঃ—উদ্ভূত হয়, মহাশনঃ - সর্বগ্রাসী; মহাপাপমা— অত্যন্ত পাপী, বিদ্ধি - জানবে; এনম — একে, ইহ — এই জড় জগতে, বৈরিণম্ — প্রধান শত্রু।
অনুবাদ:-পরমেশ্বর ভগবান বললেন- হে অর্জুন ! রজোগুণ থেকে সমুদ্ভূত কামই মানুষকে এই পাপে প্রবৃত্ত করে এবং এই কামই ক্রোধে পরিণত হয়। কাম সর্বগ্রাসী ও পাপাত্মক; কামকেই জীবের প্রধান শত্রু বলে জানবে।
শ্লোক:38:
ধুমেনাব্রিয়তে বহ্নির্যথাদর্শো মলেন চ ।
যথোল্বেনাবৃতো গর্ভস্তথা তেনেদমাবৃতম্॥৩৮॥
শব্দার্থঃ ধুমেন — ধুমের দ্বারা; আব্রিয়তে–আবৃত, বহ্নি - আগুন; যথা—যেমন, আদর্শঃ - দর্পণ, মলেন - ময়লার দ্বারা, চ–ও, যথা— যেমন; উল্বেন — জরায়ুর দ্বারা, আবৃতঃ—আবৃত থাকে; গর্ভঃ - গৰ্ভ; তথা — তেমন, তেন কামের দ্বারা, ইদম - এই, আবৃতম্ — আবৃত থাকে।
অনুবাদ:- অগ্নি যেমন ধূম দ্বারা আবৃত থাকে, দর্পণ যেমন ময়লার দ্বারা আবৃত থাকে অথবা গর্ভ যেমন জরায়ুর দ্বারা আবৃত থাকে, তেমনই জীবাত্মা বিভিন্ন মাত্রায় এই কামের দ্বারা আবৃত থাকে।
শ্লোক:39:
আবৃতং জ্ঞানমেতেন জ্ঞানিনো নিত্যবৈরিণা ।
কামরূপেণ কৌন্তেয় দুষ্পূরেণানলেন চ ॥৩৯॥
শব্দার্থঃ আবৃতম্ - আবৃত, জ্ঞানম্ — শুদ্ধ চেতনা: এতেন–এর দ্বারা; জ্ঞানিনঃ—জ্ঞানীর; নিত্যবৈরিণা—চিরশত্রুর দ্বারা, কামরূপেণ—কামরূপ, কৌন্তেয়—হে কুন্তীপুত্র, দুষ্পূরেণ—অপূরণীয়; অনলেন–অগ্নির দ্বারা, চ - ও।
অনুবাদ:- কামরূপী চির শত্রুর দ্বারা জীবের শুদ্ধ চেতনা আবৃত হয় । এই কাম দুর্বারিত অগ্নির মতো চিরঅতৃপ্ত।
শ্লোক:40:
ইন্দ্রিয়াণি মন বুদ্ধিরস্যাধিষ্ঠানমুচ্যতে ।
এতৈর্বিমোহয়ত্যেষ জ্ঞানমাবৃত্য দেহিনম্ ॥৪০॥
শব্দার্থঃ ইন্দ্রিয়াণি—ইন্দ্রিয়গুলি; মন:- মন, বুদ্ধি-বুদ্ধি, অস্য— এই কামের, অধিষ্ঠান— অধিষ্ঠান, উচ্যতে - বলা হয়, এতেঃ—এদের দ্বারা, বিমোহয়তি–বিমোহিত হয়, এবঃ—এই কাম, জ্ঞানম-জ্ঞান, আবৃত্য—আবৃত করে; দেহিনম্ - দেহাভিমানী জীবকে।
অনুবাদ:- ইন্দ্রিয়সমূহ, মন ও বুদ্ধি এই কামের আশ্রয়স্থল ৷এই ইন্দ্রিয় আদির দ্বারা কাম জীবের প্রকৃত জ্ঞানকে আচ্ছন্ন করে তাকে বিভ্রান্ত করে।
শ্লোক:41:
তস্মাত্ত্বমিন্দ্রিয়াণ্যাদৌ নিয়ম্য ভরতর্ষভ ।
পাপ্মানং প্রজহি হ্যেনং জ্ঞানবিজ্ঞাননাশনম্ ॥৪১॥
শব্দার্থঃ তস্মাৎ — সেই হেতু, ত্ত্বম্—তুমি, ইন্দ্রিয়াণি—ইন্দ্রিয়গুলি; আদৌ– প্রথমে, নিয়ম্য - নিয়ন্ত্রিত করে, ভরতর্ষত— হে ভরতশ্রেষ্ঠ, পাপ্মানম্ - পাপের প্রধান প্রতীক, প্রজহি – বিনাশ কর; হি–অবশ্যই, এনম্ - এই, জ্ঞান - জ্ঞান, বিজ্ঞান - আত্ম তত্ত্ববিজ্ঞান, নাশনম্ - নাশক।
অনুবাদ:- অতএব, হে ভরতশ্রেষ্ঠ ! তুমি প্রথমে ইন্দ্রিয়গুলিকে নিয়ন্ত্রিত করে জ্ঞান ও বিজ্ঞান-নাশক পাপের প্রতীকরূপ এই কামকে বিনাশ কর।
শ্লোক:42:
ইন্দ্রিয়াণি পরাণ্যাহুরিন্দ্রিয়েভ্যঃ পরং মনঃ ।
মনসস্তু পরা বুদ্ধির্যো বুদ্ধেঃ পরতস্ত্ত সঃ ॥৪২॥
শব্দার্থঃ ইন্দ্রিয়াণি— ইন্দ্রিয়সমূহ, পরাণি—শ্রেয়, আহুঃ—বলা হয়: ইন্দ্রিয়েভ্যঃ - ইন্দ্রিয়গুলি অপেক্ষা; পরম—শ্রেয়, মনঃ—মন: মনসঃ—মনের থেকে; তু–ও, পরা—শ্রেয়; বুদ্ধিঃ—বুদ্ধি, যঃ — যিনি: বুদ্ধেঃ - বৃদ্ধির থেকে, পরতঃ—শ্রেয়, তু - কিন্তু, সঃ– তিনি।
অনুবাদ:- স্থূল জড় পদার্থ থেকে ইন্দ্রিয়গুলি শ্রেয়; ইন্দ্রিয়গুলি থেকে মন শ্রেয়; মন থেকে বুদ্ধি শ্রেয়; আর তিনি (আত্মা) সেই বুদ্ধি থেকেও শ্রেয়।
শ্লোক:43:
এবং বুদ্ধেঃ পরং বুদ্ধা সংস্তভ্যাত্মানমাত্মনা।
জহি শত্রুং মহাবাহো কামরূপংদুরাসদম্ ॥৪৩॥
শব্দার্থঃ এবম্ — এভাবে, বুদ্ধেঃ - বুদ্ধির; পরম্ - পরতর, বুদ্ধা - জেনে; সংস্তভ্যঃ — স্থির করে, আত্মানন্—মনকে; আত্মনা—নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধির দ্বারা, জহি–জয় করে, শত্রুম্ - শত্রুকে, মহাবাহো-হে মহাবীর, কামরূপম্ — কামরূপ; দুরাসদম্- দুর্জয়।
অনুবাদ:-হে মহাবীর অর্জুন ! নিজেকে জড় ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধির অতীত জেনে,নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধির দ্বারা মনকে স্থির কর এবং এভাবেই চিৎ-শক্তির দ্বারা কামরূপ দুর্জয় শত্রুকে জয় কর।
"ওঁ তৎসদিতি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসূপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জুনসংবাদে 'জ্ঞানকর্মসন্যাসযোগো' নাম চতুর্থঽধ্যায়ঃ সমাপ্তম্।"
আরো জানতে এখানে ক্লিক করুন: শ্রীতুলসী আরতি , প্রাতঃস্মরণম্ , শ্রীগুরু প্রণাম মন্ত্র , Shrimad Bhagavad Gita in Hindi , বাংলা অর্থসহ শিবতান্ডব স্তোত্রম , মহিষাসুরমর্দিনী স্ত্রোত্র, ওঁ শান্তি মন্ত্র , শ্রী ব্যাসদেব কৃত গীতা-মাহাত্ম্য
🙏🙏🙏
উত্তরমুছুনJoy gita
উত্তরমুছুন