পঞ্চম অধ্যায় - কর্মসন্যাসযোগ
ওঁ তৎ সৎ
শ্রীমদ্ভগবদ গীতা
ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়ঃ
পঞ্চম অধ্যায় - কর্মসন্যাসযোগ
শ্লোক: 1:
অর্জুন উবাচ
সন্ন্যাসং কর্মণাং কৃষ্ণ পুনর্যোগং চ শংসসি ।
যচ্ছ্রেয় এতয়োরেকং তন্মে ব্রূহি সুনিশ্চিতম্ ॥১॥
শব্দার্থঃ সন্ন্যাসম্ - ত্যাগ, কর্মণাম্ - সমস্ত কর্মের, কৃষ্ণ - হে শ্রীকৃষ্ণ, পুনঃ - পুণরায়, যোগম্ - যোগ, চ - ও, শংসসি - প্রশংসা করছ। যৎ - যা, শ্রেয়ঃ - শ্রেয়স্কর, এতয়োঃ - এই দুটির মধ্যে, একম্ - একটি, তৎ - তা, মে - আমাকে, ব্রূহি - দয়া করে বল, সুনিশ্চিতম্ - নিশ্চিতরূপে ॥১॥
অনুবাদঃ অর্জুন বললেন- হে শ্রীকৃষ্ণ ! প্রথমে তুমি আমাকে কর্ম ত্যাগ করতে বললে এবং তারপর কর্মযোগের অনুষ্ঠান করতে বললে। এই দুটির মধ্যে কোনটি অধিক কল্যাণকর, তা সুনিশ্চিতভাবে আমাকে বল।
শ্লোক: 2:
শ্রীভগবানুবাচ
সন্ন্যাসঃ কর্মযোগশ্চ নিঃশ্রেয়সকরাবুভৌ ।
তয়োস্তু কর্মসন্ন্যাসাৎ কর্মযোগো বিশিষ্যতে ॥২॥
শব্দার্থঃ সন্ন্যাসঃ - কর্মত্যাগ, কর্মযোগঃ - কর্মযোগ, চ - ও, নিঃশ্রেয়সকরৌ - মুক্তিদায়ক, উভৌ - উভয়। তয়োঃ - সেই দুটির মধ্যে, তু - কিন্তু, কর্মসন্ন্যাসাৎ - কর্মসন্ন্যাস থেকে, কর্মযোগঃ - কর্মযোগ, বিশিষ্যতে - শ্রেয় ॥২॥
অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন- কর্মত্যাগ কর্মযোগ উভয়ই মুক্তিদায়ক। কিন্তু, এই দুটির মধ্যে কর্মযোগ কর্মসন্ন্যাস থেকে শ্রেয়।
শ্লোক: 3:
জ্ঞেয় স নিত্যসন্ন্যাসী যো ন দ্বেষ্টি ন কাঙ্ক্ষতি ।
নির্দ্বন্দ্বো হি মহাবাহো সুখং বন্ধাৎ প্রমুচ্যতে ॥৩॥
শব্দার্থঃ জ্ঞেয়ঃ - জ্ঞাতব্য, স - তিনি, নিত্য - সর্বদা, সন্ন্যাসী - সন্ন্যাসী, যঃ - যিনি, ন - না, দ্বেষ্টি - দ্বেষ করেন, ন - না, কাঙ্ক্ষতি - আকাঙ্ক্ষা করেন। নির্দ্বন্দ্বো - দ্বন্দ্ব রহিত, হি - অবশ্যই, মহাবাহো - হে মহাবীর, সুখম্ - সুখে, বন্ধাৎ - বন্ধন থেকে, প্রমুচ্যতে - মুক্ত হন ॥৩॥
অনুবাদঃ হে মহাবাহো ! যিনি তাঁর কর্মফলের প্রতি দ্বেষ বা আকাঙ্ক্ষা করেন না, তাঁকেই নিত্য সন্ন্যাসী বলে জানবে ৷ এই প্রকার ব্যক্তি দ্বন্দ্বরহিত এবং পরম সুখে কর্মবন্ধন থেকে মুক্তি লাভ করেন।
শ্লোক: 4:
সাংখ্যযোগৌ পৃথগ্ বালাঃ প্রবদন্তি ন পণ্ডিতাঃ ৷
একমপ্যাস্থিতঃ সম্যগুভয়োর্বিন্দতে ফলম্ ॥৪॥
শব্দার্থঃ সাংখ্য - জড় জগতের বিশ্লেষণ মূলক তত্ত্ব, যোগৌ - যোগকে, পৃথগ - পৃথক, বালাঃ - অল্পজ্ঞ, প্রবদন্তি - বলে, ন - না, পণ্ডিতাঃ - পন্ডিতেরা। একম্ - একটিতে, অপি - ও, আস্থিতঃ - অবস্থিত হলে, সম্যক্ - পূর্ণ রূপে, উভয়োঃ - উভয়ের, বিন্দতে - লাভ হয় , ফলম্ - ফল ॥৪॥
অনুবাদঃ অল্পজ্ঞ ব্যক্তিরাই কেবল সাংখ্যযোগ ও কর্মযোগকে পৃথক পৃথক পদ্ধতি বলে প্রকাশ করে, পণ্ডিতেরা তা বলেন না। উভয়ের মধ্যে যে-কোন একটিকে সুষ্ঠুরূপে আচরণ করলে উভয়ের ফলই লাভ হয়।
শ্লোক: 5:
যৎ সাংখ্যৈঃ প্রাপ্যতে স্থানং তদ্ যোগৈরপি গম্যতে।
একং সাংখ্যং চ যোগং চ যঃ পশ্যতি স পশ্যতি ॥৫॥
শব্দার্থঃ যৎ - যা, সাংখ্যৈঃ - সাংখ্য দর্শনের দ্বারা, প্রাপ্যতে - লাভ হয়, স্থানম্ - স্থান, তৎ - তা, যোগৈঃ - নিষ্কাম কর্মযোগের দ্বারা, অপি - ও, গম্যতে - প্রাপ্ত হওয়া যায়। একম্ - এক, সাংখ্যম্ - সাংখ্য, চ - এবং, যোগম্ - কর্মযোগকে, চ - এবং, যঃ - যিনি, পশ্যতি - দর্শন করেন, সঃ - তিনি, পশ্যতি - যথার্থ দর্শন করেন ॥৫॥
অনুবাদঃ যিনি জানেন, সাংখ্য-যোগের দ্বারা যে গতি লাভ হয়, কর্মযোগের দ্বারাও সেই গতি প্রাপ্ত হওয়া যায় এবং তাই যিনি সাংখ্যযোগ ও কর্ম-যোগকে এক বলে জানেন, তিনিই যথার্থ তত্ত্বদ্রষ্টা।
শ্লোক: 6:
সন্নাসস্ত্ত মহাবাহো দুঃখমাপ্তুমযোগতঃ ।
যোগযুক্তো মুনির্ব্রহ্ম ন চিরেণাধিগচ্ছতি ॥৬॥
শব্দার্থঃ সন্নাসঃ - সন্ন্যাস আশ্রম, তু - কিন্তু, মহাবাহো - হে মহাবাহো, দুঃখম্ - দুঃখ, আপ্তুম্ - প্রাপ্ত হয়, অযোগতঃ - নিষ্কাম কর্মযোগ ব্যতীত। যোগযুক্তঃ - নিষ্কাম কর্ম অনুষ্ঠান কারী, মুনিঃ - জ্ঞানী, ব্রহ্ম - ব্রহ্মকে, ন চিরেণ - অচিরেই, অধিগচ্ছতি - লাভ করেন ॥৬॥
অনুবাদঃ হে মহাবাহো ! কর্মযোগ ব্যতীত কেবল কর্মত্যাগরূপ সন্ন্যাস দুঃখজনক৷ কিন্তু যোগযুক্ত মুনি অচিরেই ব্রহ্মকে লাভ করেন।
শ্লোক: 7:
যোগযুক্তো বিশুদ্ধাত্মা বিজিতাত্মা জিতেন্দ্রিয়ঃ ।
সর্বভূতাত্মভূতাত্মা কুর্বন্নপি ন লিপ্যতে ॥৭॥
শব্দার্থঃ যোগযুক্তঃ - নিষ্কাম কর্মযোগে যুক্ত, বিশুদ্ধ-আত্মা - শুদ্ধ চিত্ত, বিজিতাত্মা - অসংযত, জিতেন্দ্রিয়ঃ - ইন্দ্রিয়জয়ী। সর্বভূত-আত্ম-ভূত-আত্মা - সমস্ত জীবের প্রতি দয়াশীল, কুর্বন্ - , অপি - কর্ম করেও, ন - না, লিপ্যতে - লিপ্ত হন ॥৭॥
অনুবাদঃ যোগযুক্ত জ্ঞানী বিশুদ্ধ বুদ্ধি, বিশুদ্ধ চিত্ত ও জিতেন্দ্রিয় এবং তিনি সমস্ত জীবের অনুরাগভাজন হয়ে সমস্ত কর্ম করেও তাতে লিপ্ত হন না।
শ্লোক: 8:
নৈব কিঞ্চিৎ করোমীতি যুক্তো মন্যেত তত্ত্ববিৎ ।
পশ্যন্ শৃণ্বন্ স্পৃশন্ জিঘ্রন্নশ্নন্ গচ্ছন্ স্বপন্ শ্বসন্ ॥৮॥
শব্দার্থঃ ন - না, এব - অবশ্যই, কিঞ্চিৎ - কোনকিছু, করোমি - করি, ইতি - এভাবে, যুক্তঃ - চিন্ময় চেতনায় যুক্ত, মন্যেত - মনে করেন, তত্ত্ববিৎ - তত্ত্বজ্ঞ। পশ্যন্ - দর্শন, শৃণ্বন্ - শ্রবণ, স্পৃশন্ - স্পর্শ, জিঘ্রন্ - ঘ্রান, অশ্নন্ - ভোজন, গচ্ছন্ - গমন, স্বপন্ - স্বপ্ন, শ্বসন্ - শ্বাস গ্রহণ ॥৮॥
অনুবাদঃ চিন্ময় চেতনায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তি দর্শন, শ্রবণ, স্পর্শ, ঘ্রাণ, ভোজন, গমন, নিদ্রা ও নিঃশ্বাস, আদি ক্রিয়া করেও সর্বদা জানেন যে, প্রকৃতপক্ষে তিনি কিছুই করছেন না।
Shrimad Bhagavad Gita
শ্লোক: 9:
প্রলপন্ বিসৃজন্ গৃহ্নন্নুন্মিষন্নিমিষন্নপি ।
ইন্দ্রিয়াণীন্দ্রিয়ার্থেষু বর্তন্ত ইতি ধারয়ন্ ॥৯॥
শব্দার্থঃ প্রলপন্ - প্রলাপ, বিসৃজন্ - ত্যাগ, গৃহ্নন্ - গ্রহণ, উন্মিষন্ - উন্মীলন, নিমিষন্ - নিমীলন, অপি - সত্ত্বেও। ইন্দ্রিয়াণি - ইন্দ্রিয় সমূহ, ইন্দ্রিয়ার্থেষু - ইন্দ্রিয়ের বিষয়ে, বর্তন্তে - প্রবৃত্ত হয়, ইতি - এভাবে, ধারয়ন্ - ধারণা করে ॥৯॥
অনুবাদঃ কারণ প্রলাপ, ত্যাগ, গ্রহণ, চক্ষুর উন্মেষ ও নিমেষ করার সময় তিনি সব সময় জানেন যে, জড় ইন্দ্রিয়গুলিই কেবল ইন্দ্রিয়ের বিষয়ে প্রবৃত্ত হয়েছে, তিনি নিজে কিছুই করছেন না।
শ্লোক: 10:
ব্রহ্মণ্যাধায় কর্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত্বা করোতি যঃ ।
লিপ্যতে ন স পাপেন পদ্মপত্রমিবাম্ভসা ॥১০॥
শব্দার্থঃ ব্রহ্মণি - পরমেশ্বর ভগবানকে, আধায় - সমর্পণ করে, কর্মাণি - সমস্ত কর্ম, সঙ্গম্ আসক্তি, ত্যক্ত্বা - ত্যাগ করে, করোতি - অনুষ্ঠান করে, যঃ - যিনি। লিপ্যতে - প্রভাবিত হন, ন - না, সঃ - তিনি, পাপেন - পাপের দ্বারা, পদ্মপত্রম্ - পদ্ম পাতা, ইব - মতো, অম্ভসা - জল দ্বারা ॥১০॥
অনুবাদঃ যিনি সমস্ত কর্মের ফল পরমেশ্বর ভগবানকে অর্পণ করে অনাসক্ত হয়ে কর্ম করেন, কোন পাপ তাঁকে কখনও স্পর্শ করতে পারে না, ঠিক যেমন জল পদ্মপাতাকে স্পর্শ করতে পারে না।
শ্লোক: 11:
কায়েন মনসা বুদ্ধ্যা কেবলৈরিন্দ্রিয়ৈরপি ।
যোগিনঃ কর্ম কুর্বন্তি সঙ্গং ত্যক্ত্বাত্মশুদ্ধয়ে ॥১১॥
শব্দার্থঃ কায়েন - দেহের দ্বারা, মনসা - মনের দ্বারা, বুদ্ধ্যা - বুদ্ধির দ্বারা, কেবলৈঃ - বিশুদ্ধ, ইন্দ্রিয়ৈঃ - ইন্দ্রিয়ের দ্বারা, অপি - এমনকি। যোগিনঃ - নিষ্কাম কর্মযোগী গণ, কর্ম - কর্ম, কুর্বন্তি - করেন, সঙ্গম্ - আসক্তি, ত্যক্ত্বা - পরিত্যাগ করে, আত্ম - আত্মা, শুদ্ধয়ে - শুদ্ধ করার জন্য ॥১১॥
অনুবাদঃ আত্মশুদ্ধির জন্য যোগীরা কর্মফলের আসক্তি ত্যাগ করে দেহ, মন, বুদ্ধি, এমন কি ইন্দ্রিয়ের দ্বারাও কর্ম করেন।
শ্লোক: 12:
যুক্তঃ কর্মফলং ত্যক্ত্বা শান্তিমাপ্নোতি নৈষ্ঠিকীম্ ।
অযুক্তঃ কামকারেণ ফলে সক্তো নিবধ্যতে ॥১২॥
শব্দার্থঃ যুক্তঃ - যোগযুক্ত, কর্মফলম্ - কর্মের ফল, ত্যক্ত্বা - পরিত্যাগ করে, শান্তিম্ - শান্তি, আপ্নোতি - লাভ করেন, নৈষ্ঠিকীম্ - নিষ্ঠা সম্পন্ন । অযুক্তঃ - সকাম কর্মী, কামকারেণ - কামণাপূর্বক প্রবৃত্ত হওয়ায়, ফলে - কর্ম ফলে, সক্তঃ - আসক্ত, নিবধ্যতে - আবদ্ধ হয় ॥১২॥
অনুবাদঃ যোগী কর্মফল ত্যাগ করে নৈষ্ঠিকী শান্তি লাভ করেন; কিন্তু সকাম কর্মী কর্মফলের প্রতি আসক্ত হয়ে কর্ম করার ফলে কর্মের বন্ধনে আবদ্ধ হয়।
শ্লোক: 13:
সর্বকর্মাণি মনসা সংন্যস্যাস্তে সুখং বশী ।
নবদ্বারে পুরে দেহী নৈব কুর্বন্ন কারয়ন্ ॥১৩॥
শব্দার্থঃ সর্বকর্মাণি - সমস্ত কর্ম, মনসা - মনের দ্বারা, সংন্যস্য - ত্যাগ করে, আস্তে - থাকেন, সুখম্ - সুখে, বশী - সংযত। নবদ্বারে - নয়টি দ্বার বিশিষ্ট, পুরে - নগরে, দেহী - দেহধারী জীব, ন - না, এব - অবশ্যই, কুর্বন্ - করেন, ন - না, কারয়ন্ - করান ॥১৩॥
অনুবাদঃ বাহ্যে সমস্ত কার্য করেও মনের দ্বারা সমস্ত কর্ম ত্যাগ করে জীব নবদ্বার-বিশিষ্ট দেহরূপ গৃহে পরম সুখে বাস করতে থাকেন; তিনি নিজে কিছুই করেন না এবং কাউকে দিয়েও কিছু করান না।
শ্লোক: 14:
ন কর্তৃত্বং ন কর্মাণি লোকস্য সৃজতি প্রভুঃ ।
ন কর্মফলসংযোগং স্বভাবস্তু প্রবর্ততে ॥১৪॥
শব্দার্থঃ ন - না, কর্তৃত্বম্ - কর্তৃত্ব, ন - না, কর্মাণি - কর্মসমূহ, লোকস্য - জীবের, সৃজতি - সৃষ্টি করে, প্রভুঃ - দেহরূপ নগরীর প্রভু। ন - না, কর্মফল - কর্মের ফল, সংযোগম্ - সংযোগ, স্বভাবঃ - জড়াপ্রকৃতির গুণ, তু - কিন্তু, প্রবর্ততে - প্রবৃত্ত হয় ॥১৪॥
অনুবাদঃ দেহরূপ নগরীর প্রভু জীব কর্ম সৃষ্টি করে না, সে কাউকে দিয়ে কিছু করায় না এবং সে কর্মের ফলও সৃষ্টি করে না ৷ এই সবই হয় জড়া প্রকৃতির গুণের প্রভাবে।
শ্লোক: 15:
নাদত্তে কস্যচিৎ পাপং ন চৈব সুকৃতং বিভুঃ ।
অজ্ঞানেনাবৃতং জ্ঞানং তেন মুহ্যন্তি জন্তবঃ ॥১৫॥
শব্দার্থঃ ন - না, আদত্তে - গ্রহণ করেন, কস্যচিৎ - কারও, পাপম্ - পাপ, ন - না, চ - ও, এব - অবশ্যই, সুকৃতম্ - পূণ্য, বিভুঃ - পরমেশ্বর ভগবান। অজ্ঞানেন - অজ্ঞানের দ্বারা, আবৃতম্ - আবৃত, জ্ঞানম্ - জ্ঞান, তেন - তার দ্বারা, মুহ্যন্তি - মোহিত হয়, জন্তবঃ - জীব সমূহ ॥১৫॥
অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান জীবের পাপ অথবা পুণ্য কিছুই গ্রহণ করেন না। অজ্ঞানের দ্বারা প্রকৃত জ্ঞান আবৃত হওয়ার ফলে জীবসমূহ মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
শ্লোক: 16:
জ্ঞানেন তু তদ্ জ্ঞানং যেষাং নাশিতমাত্মনঃ ।
তেষামাদিত্যবজ্ জ্ঞানং প্রকাশয়তি তৎ পরম্ ॥১৬॥
শব্দার্থঃ জ্ঞানেন - জ্ঞানের দ্বারা, তু - কিন্তু, তৎ - সেই, অজ্ঞানম্ - অজ্ঞান, যেষাম্ - যাঁদের, নাশিতম্ - বিনাশ হয়, আত্মনঃ - নিজের। তেষাম্ - তাঁদের, আদিত্যবৎ - উদীয়মান সূর্যের মত, জ্ঞানম্ - জ্ঞান, প্রকাশয়তি - প্রকাশ করে, তৎ - সেই, পরম্ - অপ্রাকৃত পরমতত্ত্বকে ॥১৬॥
অনুবাদঃ জ্ঞানের প্রভাবে যাঁদের অজ্ঞান বিনষ্ট হয়েছে, তাঁদের সেই জ্ঞান অপ্রাকৃত পরমতত্ত্বকে প্রকাশ করে, ঠিক যেমন দিনমানে সূর্যের উদয়ে সব কিছু প্রকাশিত হয়।
শ্লোক: 17:
তদ্বুদ্ধয়স্তদাত্মানস্তন্নিষ্ঠাস্তৎপরায়ণাঃ ।
গচ্ছন্ত্যপুনরাবৃত্তিং জ্ঞাননির্ধূতকল্মষাঃ ॥১৭॥
শব্দার্থঃ তদ্-বুদ্ধয়ঃ -যাঁর বুদ্ধি পরমেশ্বর ভগবানে স্থির হয়েছে, তদ্-আত্মানঃ-যাঁর মন পরমেশ্বর ভগবানে একাগ্র হয়েছে , তৎ-নিষ্ঠাঃ -কেবল ভগবানেই নিষ্ঠাসম্পন্ন:, তৎপরায়ণাঃ - যিনি সম্পূর্ণ রূপে ভগবানের আশ্রয় নিয়েছেন । গচ্ছন্তি - লাভ করেন, অপুনরাবৃত্তিম্ - মুক্তি, জ্ঞান - জ্ঞানের দ্বারা, নির্ধূত - বিধৌত, কল্মষাঃ - কলুষ ॥১৭॥
অনুবাদঃ যাঁর বুদ্ধি ভগবানের প্রতি উন্মুখ হয়েছে, মন ভগবানের চিন্তায় একাগ্র হয়েছে, নিষ্ঠা ভগবানে দৃঢ় হয়েছে এবং যিনি ভগবানকে তাঁর একমাত্র আশ্রয় বলে গ্রহণ করেছেন, জ্ঞানের দ্বারা তাঁর সমস্ত কলুষ সম্পূর্ণরূপে বিধৌত হয়েছে এবং তিনি জন্ম-মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্ত হয়েছেন।
শ্লোক: 18:
বিদ্যাবিনয়সম্পন্নে ব্রাহ্মণে গবি হস্তিনি ।
শুনি চৈব শ্বপাকে চ পণ্ডিতাঃ সমদর্শিনঃ ॥১৮॥
শব্দার্থঃ বিদ্যা- বিদ্যা, বিনয়- বিনয় , সম্পন্নে - সম্পন্ন, ব্রাহ্মণে - ব্রাহ্মণে, গবি - গাভীতে, হস্তিনি - হাতিতে। শুনি - কুকুরে, চ - এবং, এব - অবশ্যই, শ্বপাকে - চন্ডালে, চ - এবং, পণ্ডিতাঃ - পন্ডিতেরা, সমদর্শিনঃ - সম়দর্শী ॥১৮॥
অনুবাদঃ জ্ঞানবান পণ্ডিতেরা বিদ্যা-বিনয়সম্পন্ন ব্রাহ্মণ, গাভী, হস্তী, কুকুর ও চণ্ডাল সকলের প্রতি সমদর্শী হন।
শ্লোক: 19:
ইহৈব তৈর্জিতঃ সর্গো যেষাং সাম্যে স্থিতং মনঃ ।
নির্দোষং হি সমং ব্রহ্ম তস্মাদ্ ব্রহ্মণি তে স্থিতাঃ ॥১৯॥
শব্দার্থঃ ইহ—এই জীবনে, এব - অবশ্যই, তৈঃ - তাদের দ্বারা, জিতঃ— বিজিত, সর্গঃ - - জন্ম ও মৃত্যু: যেযাম্— যাঁদের, সাম্যে— সমভাবে; স্থিতম্ — স্থিত; মনঃ—মন। নির্দোষম্― নির্দোষ, হি—অবশ্যই: সমম্ – সমভাব; ব্রহ্ম ব্ৰহ্ম; তস্মাৎ—সেই হেতু; ব্রহ্মণি—ব্রহ্মে, তে—তারা, স্থিতাঃ — অবস্থিত।।১৯।।
অনুবাদঃ যাঁদের মন সাম্যে অবস্থিত হয়েছে, তাঁরা ইহলোকেই জন্ম ও মৃত্যুর সংসার জয় করেছেন। তাঁরা ব্রহ্মের মতো নির্দোষ। তাই তাঁরা ব্রহ্মেই অবস্থিত হয়ে আছেন।
শ্লোক: 20:
ন প্রহৃষ্যেৎ প্রিয়ং প্রাপ্য নোদ্বিজেৎ প্রাপ্য চাপ্রিয়ম্ ।
স্থিরবুদ্ধিরসংমূঢ়ো ব্রহ্মবিদ্ ব্রহ্মণি স্থিতঃ ॥২০॥
শব্দার্থঃ ন–না: প্রহৃষ্যেৎ—হর্ষে উৎফুল্ল হন, প্রিয়ম্ – প্রিয় বস্তু প্রাপ্য লাভ করে, ন– না, উদ্বিজেৎ—বিচলিত হন; প্রাপ্য - লাভ করে; চ–ও অপ্রিয়ম্ - অপ্রিয় বস্তু, স্থিরবুদ্ধিঃ—স্থির বুদ্ধিসম্পন্ন, অসংমূঢ়ঃ- মোহশূন্য, ব্রহ্মবিৎ-ব্রহ্মজ্ঞানী, ব্ৰহ্মণি— ব্রহ্মে, স্থিতঃ—অবস্থিত।
অনুবাদঃ যে ব্যক্তি প্রিয় বস্তুর প্রাপ্তিতে উৎফুল্ল হন না এবং অপ্রিয় বস্তুর প্রাপ্তিতে বিচলিত হন না, যিনি স্থিরবুদ্ধি, মোহশূন্য ও ভগবৎ-তত্ত্ববেত্তা, তিনি ব্রহ্মেই অবস্থিত ।
শ্লোক: 21:
বাহ্যস্পর্শেষ্বসক্তাত্মা বিন্দত্যাত্মনি যৎ সুখম্ ।
স ব্রহ্মযোগযুক্তাত্মা সুখমক্ষয়মশ্নুতে ॥২১॥
শব্দার্থঃ বাহ্যস্পর্শেষু–বিষয়সুখে; অসক্তাত্মা- অনাসক্ত চিত্র ব্যক্তি, বিন্দতি - অনুভব করেন; আত্মনি—আত্মায়, যত্—যা; সুখম্ — সুখ, সঃ — তিনি, ব্রহ্ম—ব্রহ্মে; যোগযুক্তাত্মা যোগযুক্ত হয়ে, সুখম্- সুখ, অক্ষয়-অন্তহীন; অশ্নুতে— ভোগ করেন।।২১।।
অনুবাদঃ সেই প্রকার ব্রহ্মবিৎ পুরুষ কোন রকম জড় ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের প্রতি আকৃষ্ট হন না, তিনি চিদ্গত সুখ লাভ করেন। ব্রহ্মে যোগযুক্ত হয়ে তিনি অক্ষয় সুখ ভোগ করেন।
শ্লোক: 22:
যে হি সংস্পর্শজা ভোগা দুঃখযোনয় এব তে ।
আদ্যন্তবন্তঃ কৌন্তেয় ন তেষু রমতে বুধঃ ॥২২॥
শব্দার্থঃ যে–যে সমস্ত; হি–অবশ্যই, সংস্পর্শজাঃ - জড় ইন্দ্রিয়ের সংযোগ অনিত, ভোগাঃ – ভোগসমূহ, দুঃখ–দুঃখ, যৌনয়ঃ - কারণ, এব অবশ্যই, তে – সেই সমস্ত, আদি - আদি, অন্তবন্তঃ - অন্তবিশিষ্ট; কৌন্তেয় – হে কুত্তীপুত্ৰ, ন - না; তেষু — তাতে; রমতে—প্রীতি লাভ করেন; বুধঃ—বিবেকী ব্যক্তি।।২২।।
অনুবাদঃ বিবেকবান পুরুষ দুঃখের কারণ যে ইন্দ্রিয়জাত বিষয়ভোগ তাতে আসক্ত হন না। হে কৌন্তেয় ! এই ধরনের সুখভোগ আদি ও অন্তবিশিষ্ট৷ তাই, জ্ঞানী ব্যক্তিরা তাতে প্রীতি লাভ করেন না।
শ্লোক: 23:
শক্নোতীহৈব যঃ সোঢুং প্রাক্ শরীরবিমোক্ষণাৎ ।
কামক্রোধোদ্ভবং বেগং স যুক্তঃ স সুখী নরঃ ॥২৩॥
শব্দার্থঃ শক্নোতি—সক্ষম; ইহ এব—এই শরীরে, যঃ — যিনি, সোঢুম্— সহ্য করতে, প্রাকৃ—পূর্বে, শরীর - শরীর, বিমোক্ষণাৎ - ত্যাগ করার, কাম - কাম, ক্রোধ – ক্রোধ; উদ্ভবম্ – উদ্ভূত বেগম্—বেগ, সঃ — তিনি, যুক্তঃ — আত্ম সমাহিত; সঃ — তিনি; সুখী—সুখী; নরঃ — মানুষ।।২৩।।
অনুবাদঃ এই দেহ ত্যাগ করার পূর্বে যিনি কাম, ক্রোধ থেকে উদ্ভূত বেগ সহ্য করতে সক্ষম হন, তিনি যোগী এবং এই জগতে তিনিই সুখী হন।
শ্লোক: 24:
যোহন্তঃসুখোহন্তরারামস্তথান্তর্জ্যোতিরেব যঃ ।
স যোগী ব্রহ্মনির্বাণং ব্রহ্মভূতোহধিগচ্ছতি ॥২৪॥
শব্দার্থঃ যঃ — যিনি; অন্তঃসুখঃ - অন্তরে সুখী; অন্তরারামঃ- আত্মাতেই ক্রীড়াশীল, তথা— এবং, অন্তর্জ্যোতিঃ- অন্তবর্তী আত্মাই যাঁর লক্ষ্য, এব–নিশ্চিতরূপে; যঃ — যিনি; সঃ—তিনি, যোগী — যোগী, ব্রহ্মনির্বাণম্ - ব্রহ্মনির্বাণ, ব্রহ্মভূতঃ - ব্রহ্মে অবস্থিত হয়ে, অধিগচ্ছতি - লাভ করেন।।২৪।।
অনুবাদঃ যিনি আত্মাতেই সুখ অনুভব করেন, যিনি আত্মাতেই ক্রীড়াযুক্ত এবং আত্মাই যাঁর লক্ষ্য, তিনিই যোগী৷ তিনি ব্রহ্মে অবস্থিত হয়ে ব্রহ্মনির্বাণ লাভ করেন।
শ্লোক: 25:
লভন্তে ব্রহ্মনির্বাণম্ ঋষয়ঃ ক্ষীণকল্মষাঃ ।
ছিন্নদ্বৈধা যতাত্মানঃ সর্বভূতহিতে রতাঃ ॥২৫॥
শব্দার্থঃ লভন্তে—লাভ করেন; ব্রহ্মানির্বাণম্ – ব্রহ্মনির্বাণ, ঋষয়ঃ — ঋষিগণ; ক্ষীণকল্মষাঃ - নিষ্পাপ, ছিন্ন—ছিন্ন করে, দ্বৈধাঃ — দ্বিধা, যতাত্মানঃ — সংযতচিত্ত; সর্বভূত— সমস্ত জীবের, হিতে - কল্যাণে, রতাঃ - রত।
অনুবাদঃ সংযতচিত্ত, সমস্ত জীবের কল্যাণে রত এবং সংশয় রহিত নিষ্পাপ ঋষিগণ ব্রহ্মনির্বাণ লাভ করেন।
শ্লোক: 26:
কামক্রোধবিমুক্তানাং যতীনাং যতচেতসাম্ ।
অভিতো ব্রহ্মনির্বাণং বর্ততে বিদিতাত্মনাম্ ॥২৬॥
শব্দার্থঃ কাম—কাম, ক্রোধ—ক্রোধ, বিমুক্তানাম্ – মুক্ত, যতীনাম্-সন্ন্যাসীদের; যতচেতসাম্–সংঘতচিত্ত; অভিতঃ—সর্বতোভাবে অচিরেই, ব্রহ্মনির্বাণম্ — ব্রহ্মানির্বাণ; বর্ততে–উপস্থিত হয়; বিদিতাত্মনাম্— আত্মজ্ঞ।।২৬।।
অনুবাদঃ কাম-ক্রোধশূন্য, সংযতচিত্ত, আত্মতত্ত্বজ্ঞ সন্ন্যাসীরা সর্বতোভাবে অচিরেই ব্রহ্মনির্বাণ লাভ করেন।
শ্লোক: 27:
স্পর্শান্ কৃত্বা বহির্বাহ্যাংশ্চক্ষুচৈবান্তরে ভ্রুবোঃ ।
প্রাণাপানৌ সমৌ কৃত্বা নাসাভ্যন্তরচারিণৌ ॥২৭॥
শব্দার্থঃ স্পর্শান— শব্দ আদি ইন্দ্রিয়ের বিষয়; কৃত্বা করে, ৰহিঃ - বহিষ্কৃত, বাহ্যান্ - বাহ্য, চক্ষু–চক্ষু; চ–ও; এব— নিশ্চিতভাবে, অন্তরে – মধ্যে, ভ্রুবোঃ– ভ্রুদ্বয়ের, প্রাণাপানৌ– প্রাণ ও অপান বায়ু, সমৌ—সমান, কৃত্বা- করে, নাসাভ্যন্তর - নাসিকার মধ্যে, চারিণৌ - বিচরণশীল।
অনুবাদঃ মন থেকে বাহ্যইন্দ্রিয়ের বিষয় প্রত্যাহার করে, ভ্রূযুগলের মধ্যে দৃষ্টি স্থির করে, নাসিকার মধ্যে বিচরণশীল প্রাণ ও অপান বায়ুর উর্ধ্ব ও অধোগতি রোধ করে, ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধি সংযম করে এবং ইচ্ছা, ভয় ও ক্রোধ শূন্য হয়ে যে মুনি সর্বদা বিরাজ করেন, তিনি নিশ্চিতভাবে মুক্ত।
শ্লোক: 28:
যতেন্দ্রিয়মনোবুদ্ধির্মুনির্মোক্ষপরায়ণঃ ।
বিগতেচ্ছাভয়ক্রোধো যঃ সদা মুক্ত এব সঃ ॥২৮॥
শব্দার্থঃ যত— সংযত, ইন্দ্রিয় — ইন্দ্রিয়; মনঃ—মন; বুদ্ধিঃ—বুদ্ধি: মুনিঃ — মুনি মোক্ষ - মুক্তি পরায়ণ — পরায়ণ, বিগত—বর্জিত; ইচ্ছা—ইচ্ছা: ভয়—ভয়, ক্রোধঃ—ক্রোধ: যঃ — যিনি সদা - সর্বদা, মুক্ত: — মুক্ত, এব–অবশ্যই, সঃ — তিনি।
শ্লোক: 29:
ভোক্তারং যজ্ঞতপসাং সর্বলোকমহেশ্বরম্ ।
সুহৃদং সর্বভূতানাং জ্ঞাত্বা মাং শান্তিমৃচ্ছতি ॥২৯॥
শব্দার্থঃ ভোক্তারম্ – ভোক্তা, যজ্ঞ– যজ্ঞ, তপসাম্ - তপস্যার, সর্বলোক—সর্বলোকের; মহেশ্বরম্ — পরম ঈশ্বর। সুহৃদম্ – সুহৃদ; সর্ব—সমস্ত, ভূতানাম্ - জীবের, জ্ঞাত্বা - এভাবে জেনে; মাম্—আমাকে (শ্রীকৃষ্ণকে); শান্তিম্ - জড় দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্তি, ঋচ্ছতি - লাভ করেন।
অনুবাদঃ আমাকে সমস্ত যজ্ঞ ও তপস্যার পরম ভোক্তা, সর্বলোকের মহেশ্বর এবং সমস্ত জীবের সুহৃদরূপে জেনে যোগীরা জড় জগতের দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্ত হয়ে শান্তি লাভ করেন।
ওঁ তৎসদিতি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসূপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জুনসংবাদে 'কর্মসন্ন্যাসযোগো' নাম পঞ্চমোহধ্যায়ঃ
Post a Comment