ষষ্ঠ অধ্যায় - ধ্যানযোগ যোগ
ওঁ তৎ সৎ
শ্রীমদ্ভগবদ গীতা
ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়:
ষষ্ঠ অধ্যায় - ধ্যানযোগ যোগ
শ্লোক:1:
শ্রীভগবানুবাচঃ
অনাশ্রিতঃ কর্মফলং কার্যং কর্ম করোতি যঃ ৷
স সন্ন্যাসী চ যোগী চ নিরগ্নির্ন চাক্রিয়ঃ ॥১॥
শব্দার্থঃ শ্রীভগবান্ উবাচ—পরমেশ্বর ভগবান বললেন, অনাশ্রিতঃ - আশ্রয় বা অপেক্ষা না করে, কর্মফলম্ – কর্মফলের, কার্যম্ - কর্তব্য; কর্ম-কর্ম, করোতি— অনুষ্ঠান করেন; যঃ—যিনি, সঃ - তিনি, সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসী, চ-ও, যোগী—যোগী, চ - ও, ন—না, নিরগ্নিঃ - অগ্নি রহিত নন, চ―ও, অক্রিয়ঃ - নিষ্ক্রিয়।
অর্থ:- পরমেশ্বর ভগবান বললেন- যিনি অগ্নিহোত্রাদি কর্ম ত্যাগ করেছেন এবং দৈহিক চেষ্টাশূন্য তিনি সন্ন্যাসী বা যোগী নন৷ যিনি কর্মফলের প্রতি আসক্ত না হয়ে তাঁর কর্তব্য কর্ম করেন তিনিই যথার্থ সন্ন্যাসী বা যোগী।
শ্লোক:2:
যং সন্ন্যাসমিতি প্রাহুর্যোগং তং বিদ্ধি পাণ্ডব ৷
ন হ্যসংন্যস্তসংকল্পো যোগী ভবতি কশ্চন ॥২॥
শব্দার্থঃ যম্— যাকে, সন্ন্যাসম্— সন্ন্যাস; ইতি—এভাবে, প্রাহুঃ - বলা হয়, যোগম্— পরমেশ্বর ভগবানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পন্থাকে; তম্― তাকে, বিদ্ধি - জানবে, পাণ্ডব—হে পাণ্ডুপুত্র; ন - না হি—অবশাই, অসংন্যস্ত— ত্যাগ না করে, সংকল্পঃ —সংকল্প; যোগী—যোগী, ভবতি—হন, কশ্চন—কেউ।
অর্থ:- হে পাণ্ডব! যাকে সন্ন্যাস বলা যায়, তাকেই যোগ বলা যায়, কারণ ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের বাসনা ত্যাগ না করলে কখনই যোগী হওয়া যায় না।
শ্লোক:3:
আরুরুক্ষোঃর্মুনের্যোগং কর্ম কারণমুচ্যতে ৷
যোগারূঢ়স্য তস্যৈব শমঃ কারণমুচ্যতে ॥৩॥
শব্দার্থঃ আরুরুক্ষোঃ — আরোহণ করতে ইচ্ছুক, মুনেঃ– মুনির, যোগম্—অষ্টাঙ্গযোগ, কর্ম —কর্ম, কারণম্ - কারণ, উচ্যতে - বলা হয়। যোগ— অষ্টাঙ্গযোগ, আরূঢ়স্য - হয়েছেন; তস্য—তার; এব - অবশ্যই; শমঃ — সমস্ত কর্মের নিবৃত্তি; কারণম্ - কারণ, উচ্যতে - বলা হয়।
অর্থ:- অষ্টাঙ্গযোগ অনুষ্ঠানে যারা নবীন, তাদের পক্ষে কর্ম অনুষ্ঠান করাই উৎকৃষ্ট সাধন, আর যাঁরা ইতিমধ্যেই যোগরূঢ় হয়েছেন তাঁদের পক্ষে সমস্ত কর্ম থেকে নিবৃত্তিই উৎকৃষ্ট সাধন।
শ্লোক:4:
যদা হি নেন্দ্রিয়ার্থেষু ন কর্মস্বনুষজ্জতে ৷
সর্বসংকল্পসন্ন্যাসী যোগারূঢ়স্তদোচ্যতে ॥৪॥
শব্দার্থঃ যদা—যখন; হি—অবশ্যই; ন-না; ইন্দ্ৰিয়ার্থেষু- ইন্দ্রিয়ভোগ্য বিষয়ে; ন–না; কর্মসু—সকাম কর্মে; অনুষজ্জতে - আসক্ত হন; সর্বসংকল্প—সমস্ত জড় বাসনা; সন্ন্যাসী— ত্যাগী যোগারূঢ়ঃ– যোগারূঢ়; তদা—তখন; উচ্যতে - বলা হয়।
অর্থ:- যখন যোগী জড় সুখভোগের সমস্ত সংকল্প ত্যাগ করে ইন্দ্রিয়ভোগ্য বিষয়ে এবং সকাম কর্মের প্রতি আসক্তি রহিত হন, তখন তাঁকেই যোগারূঢ় বলা হয়।
শ্লোক:5:
উদ্ধরেদাত্মনাত্মানং নাত্মানমবসাদয়েৎ ৷
আত্মৈব হ্যাত্মনো বন্ধুরাত্মৈব রিপুরাত্মনঃ ॥৫॥
শব্দার্থঃ উদ্ধরেৎ—উদ্ধার করা কর্তব্য; আত্মনা—মনের দ্বারা; আত্মানম্ — জীবাত্মাকে; ন– না; আত্মানম্ – আত্মাকে; অবসাদয়েৎ — অধঃপতিত করা; আত্মা—মন; এব— অবশ্যই; হি—বাস্তবিকই; আত্মনঃ জীবাত্মার; বন্ধুঃ — বন্ধু, আত্মা — মন ;এব - অবশ্যই; রিপুঃ—শত্রু; আত্মনঃ—জীবাত্মার।
অর্থ:- মানুষের কর্তব্য তার মনের দ্বারা নিজেকে জড় জগতের বন্ধন থেকে উদ্ধার করা, মনের দ্বারা আত্মাকে অধঃপতিত করা কখনই উচিত নয়। মনই জীবের অবস্থা ভেদে বন্ধু ও শত্রু হয়ে থাকে ।
শ্লোক:6:
বন্ধুরাত্মাত্মনস্তস্য যেনাত্মৈবাত্মনা জিতঃ ৷
অনাত্মনস্ত্ত শত্রুত্বে বর্তেতাত্বৈব শত্রুবৎ ॥৬॥
শব্দার্থঃ বন্ধু: – বন্ধু, আত্মা—মন, আত্মনঃ— জীবের, তস্য— তাঁর, যেন - যার দ্বারা, আত্মা—মন; এব–অবশ্যই, আত্মনা— জীবাত্মা কর্তৃক, জিতঃ — বিজিত, অনাত্মনঃ —যিনি মনকে সংযত করতে অক্ষম, তু– কিন্তু, শত্রুত্বে - শত্রুতার জন্য; বর্তেত– থাকেন; আত্মৈব—সেই মন; শত্রুবৎ - শত্রুর মতো।
অর্থ:- যিনি তাঁর মনকে জয় করেছেন, তাঁর মন তাঁর পরম বন্ধু, কিন্তু যিনি তা করতে অক্ষম, তাঁর মনই তাঁর পরম শত্রু।
শ্লোক:7:
জিতাত্মনঃ প্রশান্তস্য পরমাত্মা সমাহিতঃ ৷
শীতোষ্ণসুখদুঃখেষু তথা মানাপমানয়োঃ ॥৭॥
শব্দার্থঃ জিতাত্মনঃ—জিতেন্দ্রিয়, প্রশান্তস্য - প্রশান্ত ব্যক্তির, পরমাত্মা-পরমাত্মা, সমাহিতঃ —সমাধিস্থ, শীত—শীত, উষ্ণ— তাপ, সুখ - সুখ, দুঃখেষু - দুঃখ, তথা—ও; মান-সম্মান অপমানয়োঃ- অপমান।
অর্থ:- জিতেন্দ্রিয় ও প্রশান্তচিত্ত ব্যক্তি পরমাত্মাকে উপলব্ধি করতে পেরেছেন। তাঁর কাছে শীত ও উষ্ণ, সুখ ও দুঃখ এবং সন্মান ও অপমান সবই সমান।
শ্লোক:8:
জ্ঞানবিজ্ঞানতৃপ্তাত্মা কূটস্থো বিজিতেন্দ্রিয়ঃ৷
যুক্ত ইত্যুচ্যতে যোগী সমলোষ্ট্রাশ্মকাঞ্চনঃ ॥৮॥
শব্দার্থঃ জ্ঞান—জ্ঞান; বিজ্ঞান–উপলব্ধ জ্ঞান; তৃপ্ত - তৃপ্ত, আত্মা - জীব; কূটস্থঃ — চিন্ময় স্তরে অধিষ্ঠিত; বিজিতেন্দ্রিয়ঃ - জিতেন্দ্রিয়, যুক্ত - আত্মজ্ঞান লাভের যোগ্য; ইতি—এভাবে, উচ্যতে - বলা হয়, যোগী—যোগী, সম-সমদর্শী, লোষ্ট্র—মৃৎখণ্ড, অশ্ম–পাথর, কাঞ্চনঃ - সোনা।
অর্থ:- যে যোগী শাস্ত্রজ্ঞান ও তত্ত্ব অনুভূতিতে পরিতৃপ্ত, যিনি চিন্ময় স্তরে অধিষ্ঠত ও জিতেদ্রিয় এবং যিনি মৃৎখণ্ড, প্রস্তর ও সুবর্ণে সমদর্শী, তিনি যোগরূঢ় বলে কথিত হন।
শ্লোক:9:
সুহৃন্মিত্রার্যুদাসীনমধ্যস্থদ্বেষ্যবন্ধুষু ৷
সাধুষ্বপি চ পাপেষু সমবুদ্ধির্বিশিষ্যতে ॥৯॥
শব্দার্থঃ সুহৃৎ—স্বভাবত হিতাকাঙ্ক্ষী; মিত্র— স্নেহবশত হিতকারী, অরি - শত্রু, উদাসীন— বিবাদের মধ্যেও নিরপেক্ষ, মধ্যস্থ–বিবাদ মিমাংসাকারী; দ্বেষ্য— মৎসর, বন্ধুষু— বন্ধুতে, সাধুষু—সাধুতে; অপি–ও, চ–এবং, পাপেষু—পাপীতে, সমবুদ্ধিঃ - সমবুদ্ধি; বিশিষাতে–শ্রেষ্ঠতা লাভ করেন।
অর্থ:- যিনি সুহৃদ, মিত্র, শত্রু, উদাসীন, মধ্যস্থ, মৎসর, বন্ধু, ধার্মিক ও পাপাচারী- সকলের প্রতি সমবুদ্ধি, তিনিই শ্রেষ্ঠতা লাভ করেন।
শ্লোক:10:
যোগী যুঞ্জীত সততমাত্মানং রহসি স্থিতঃ ৷
একাকী যতচিত্তাত্মা নিরাশীরপরিগ্রহঃ ॥১০॥
শব্দার্থঃ যোগী—যোগী, যুঞ্জীত—সমাধিযুক্ত করবেন; সততম্- সর্বদা, আত্মানম্ (দেহ, মন ও আত্মার দ্বারা) নিজেকে, রহসি—নির্জন স্থানে, স্থিতঃ — অবস্থিত হয়ে; একাকী—একলা; যতচিত্তাত্মা–সংযতচিত্ত, নিরাশীঃ — নিস্পৃহ হয়ে, অপরিগ্রহঃ— পরিগ্রহ রহিত হয়ে।
অর্থ:- যোগরূঢ় ব্যক্তি সর্বদা পরব্রহ্মে সম্পর্কযুক্ত হয়ে তাঁর দেহ, মন ও নিজেকে নিয়োজিত করবেন; তিনি একাকী নির্জন স্থানে বসবাস করবেন এবং সর্বদা সতর্কভাবে তাঁর মনকে বশীভূত করবেন৷ তিনি বাসনামুক্ত ও পরিগ্রহ রহিত হবেন।
শ্লোক:11:
শুচৌ দেশে প্রতিষ্ঠাপ্য স্থিরমাসনমাত্মনঃ ৷
নাত্যুচ্ছ্রিতং নাতিনীচং চৈলাজিনকুশোত্তরম্ ॥১১॥
শব্দার্থঃ শুচৌ—পবিত্র, দেশে—স্থানে, প্রতিষ্ঠাপ্য— স্থাপন করে, স্থিরম্ – স্থির, আসনম্ - আসন, আত্মনঃ—নিজের, ন―না, অতি - অতি; উচ্ছ্ৰিতম্― উচ্চ, ন - না, অতি — অতি, নীচম্-নীচু, চৈলাজিনকুশোত্তরম্ - কুশাসনের উপর মৃগচর্ম, তার উপরে বস্ত্রাসন রেখে।
শ্লোক:12:
তত্রৈকাগ্রং মনঃ কৃত্বা যতচিত্তেন্দ্রিয়ক্রিয়ঃ ৷
উপবিশ্যাসনে যুঞ্জ্যাদ্ যোগমাত্মবিশুদ্ধয়ে ॥১২॥
শব্দার্থঃ তত্র—সেই আসনে, একাগ্রম্ একাগ্র মনঃ — মনকে, কৃত্বা - করে, যতচিত্ত—মনকে সংযত করে, ইন্দ্রিয়—ইন্দ্রিয়, ক্রিয়ঃ কার্যকলাপ, উপবিশ্য— উপবেশন করে; আসনে - আসনে, যুঞ্জাৎ— অভ্যাস করবেন, যোগম্ - যোগ অভ্যাস, আত্ম-অন্তঃকরণ; বিশুদ্ধয়ে - শুদ্ধ করবার জন্য।
অর্থ:- যোগ অভ্যাসের নিয়ম এই যে, কুশাসনের উপর মৃগচর্মের আসন, তার উপরে বস্ত্রাসন রেখে অত্যন্ত উচ্চ বা অত্যন্ত নীচ না করে, সেই আসন পবিত্র স্থানে স্থাপন করে তাতে আসীন হবেন। সেখানে উপবিষ্ট হয়ে চিত্ত, ইন্দ্রিয় ও ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রিত করে চিত্ত শুদ্ধির জন্য মনকে একাগ্র করে যোগ অভ্যাস করবেন।
শ্লোক:13:
সমং কায়শিরোগ্রীবং ধারয়ন্নচলং স্থিরঃ ৷
সংপ্রেক্ষ্য নাসিকাগ্রং স্বং দিশশ্চানবলোকয়ন্ ॥১৩॥
শব্দার্থঃ সমম্ –সরল; কায়শিরঃ – শরীর ও মস্তক; গ্রীবম্ – গ্রীবা, ধারয়ন - ধারণ করে; অচলম্ – নিশ্চলভাবে, স্থিরঃ– স্থির হয়ে; সংপ্রেক্ষ্য– দৃষ্টি রেখে, নাসিকাগ্রম্ – নাসিকার অগ্রভাগে, স্বম্ — স্বীয়; দিশঃ — সমস্ত দিকে, চ–ও, অনবলোকয়ন্— অবলোকন না করে৷
শ্লোক:14:
প্রশান্তাত্মা বিগতভীর্ব্রহ্মচারিব্রতে স্থিতঃ ৷
মনঃ সংযম্য মচ্চিত্তো যুক্তঃ আসীত মৎপরঃ ॥১৪॥
শব্দার্থঃ প্রশান্ত— প্রশান্ত, আত্মা— চিত্ত, বিগতভী:—নির্ভয়, ব্রহ্মচারিব্রতে—ব্রহ্মচর্য ব্রতে, স্থিতঃ— অবস্থিত, মনঃ- মন, সংযম্য – সম্পূর্ণরূপে সংযত করে, মৎ— আমাতে (শ্রীকৃষ্ণে), চিত্ত: – চিত্ত: যুক্ত— সমাহিতভাবে, আসীত—অবস্থান করবেন; মৎ - আমাকে, পরঃ—চরম লক্ষ্য।
অর্থ:- শরীর, মস্তক ও গ্রীবাকে সমানভাবে রেখে অন্য দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ না করে, নাসিকার অগ্রভাগে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে প্রশান্তাত্মা, ভয়শূন্য ও ব্রহ্মচর্য-ব্রতে স্থিত পুরুষ মনকে সমস্ত জড় বিষয় থেকে প্রত্যাহার করে, আমাকে জীবনের চরম লক্ষ্যরূপে স্থির করে হৃদয়ে আমার ধ্যানপূর্বক যোগ অভ্যাস করবেন।
শ্লোক:15:
যুঞ্জন্নেবং সদাত্মানং যোগী নিয়তমানসঃ ৷
শান্তিং নির্বাণপরমাং মৎসংস্থামধিগচ্ছতি ॥১৫॥
শব্দার্থঃ যুঞ্জন্ - অভ্যাস করে; এবম্ - এই প্রকারে, সদা-সর্বদা, আত্মানম্ – দেহ, মন ও আত্মাকে, যোগী—যোগী; নিয়তমানসঃ— সংযতচিত্ত; শাস্তিম্—শাস্তি, নির্বাণ পরমাম্— জড় বন্ধনমুক্তি, মৎসংস্থাম্ – চিৎ-জগৎ, অধিগচ্ছতি — প্রাপ্ত হন।
অর্থ:- এভাবেই দেহ, মন ও কার্যকলাপ সংযত করার অভ্যাসের ফলে যোগীর জড় বন্ধন মুক্ত হয় এবং তিনি তখন আমার ধাম প্রাপ্ত হন।
শ্লোক:16:
নাত্যশ্নতস্ত্ত যোগোহস্তি ন চৈকান্তমনশ্নতঃ।
ন চাতিস্বপ্নশীলস্য জাগ্রতো নৈব চার্জুন ॥১৬।।
শব্দার্থঃ ন—না, অতি—অত্যধিক, অশ্নতঃ—ভোজনকারী, তু– কিন্তু, যোগঃ—পরমেশ্বর ভগবানের সঙ্গে যুক্ত; অস্তি—হয়, ন–না, চ–ও; একান্তম্ – নিতান্ত, অনশ্বতঃ —অনাহারীর; ন–না; চ–ও, অতি - অত্যন্ত স্বপ্নশীলস্য-নিদ্রাশীলের, জাগ্রতঃ —জাগরণকারীর; ন–না, এব - কখনও চ–এবং, অর্জুন— হে অর্জুন।
অর্থ:- অধিক ভোজনকারী, নিতান্ত অনাহারী, অধিক নিদ্রাপ্রিয় ও নিদ্রাশূন্য ব্যক্তির যোগী হওয়া সম্ভব নয়।
শ্লোক:17:
যুক্তাহারবিহারস্য যুক্তচেষ্টস্য কর্মসু ৷
যুক্তস্বপ্নাববোধস্য যোগো ভবতি দুঃখহা ॥১৭॥
শব্দার্থঃ যুক্ত– নিয়ন্ত্রিত, আহার— ভোজন, বিহারস্য — বিহার; যুক্ত—নিয়ন্ত্রিত, চেষ্টসা— চেষ্টাবিশিষ্ট; কর্মষু–কর্তব্যকর্ম অনুষ্ঠানে, যুক্ত—নিয়ন্ত্রিত, স্বপ্নাববোধস্য – নিদ্রিত ও জাগ্রত ব্যক্তির, যোগ:—যোগ অভ্যাস, ভবতি — হয়; দুঃখহা—দুঃখনাশক।
অর্থ:- যিনি পরিমিত আহার ও বিহার করেন, পরিমিত প্রয়াস করেন, যাঁর নিদ্রা ও জাগরণ নিয়মিত, তিনিই যোগ অভ্যাসের দ্বারা সমস্ত জড়-জাগতিক দুঃখের নিবৃত্তি সাধন করতে পারেন।
শ্লোক:18:
যদা বিনিয়তং চিত্তমাত্মন্যেবাবতিষ্ঠতে ৷
নিস্পৃহঃ সর্বকামেভ্যো যুক্ত ইত্যুচ্যতে তদা ॥১৮॥
শব্দার্থঃ যদা—যখন, বিনিয়তম্ – বিশেষভাবে সংযত, চিত্তম্—মন এবং তার কার্যকলাপ, আত্মনি—আত্মাতে, এব–নিশ্চিতভাবে, অবতিষ্ঠতে - অবস্থান করে। নিস্পৃহঃ— স্পৃহাশূন্য; সর্ব—সর্বপ্রকার, কামেভ্যঃ - কামনা থেকে, যুক্তঃ—যোগযুক্ত, ইতি— এভাবে; উচ্যতে - বলা হয়; তদা—তখন।
অর্থ:- যোগী যখন অনুশীলনের দ্বারা চিত্তবৃত্তির নিরোধ করেন এবং সমস্ত জড় কামনা-বাসনা থেকে মুক্ত হয়ে আত্মাতে অবস্থান করেন, তখন তিনি যোগযুক্ত হয়েছেন বলে বলা হয়।
শ্লোক:19:
যথা দীপো নিবাতস্থো নেঙ্গতে সোপমা স্মৃতা ৷
যোগিনো যতচিত্তস্য যুঞ্জতো যোগমাত্মনঃ ॥১৯॥
শব্দার্থঃ যথা—যেমন; দীপঃ—প্রদীপ, নিবাতস্থ – বায়ুশূন্য স্থানে, ন―না; ইঙ্গতে — বিচলিত হয়; সা উপমা—সেই উপমা, স্মৃতা— বিবেচিত হয়, যোগিনঃ—যোগীর, যতচিত্তস্য—সংযতচিত্ত; যুঞ্জতঃ– অভ্যাসকারী, যোগম্ - যোগ, আত্মন - আত্ম বিষয়ক।
অর্থ:- বায়ুশূন্য স্থানে দীপশিখা যেমন কম্পিত হয় না, চিত্তবৃত্তির নিরোধ অভ্যাসকারী যোগীর চিত্তও তেমনইভাবে অবিচলিত থাকে।
শ্লোক:20:
যত্রোপরমতে চিত্তং নিরুদ্ধং যোগসেবয়া ৷
যত্র চৈবাত্মনাত্মানং পশ্যন্নাত্মনি তুষ্যতি ॥২০॥
শব্দার্থঃ যত্র - যে অবস্থায়, উপরমতে— নিবৃত্তি হয়, চিত্তম্-চিত্ত, নিরুদ্ধম্- বিষয় থেকে প্রত্যাহৃত হয়; যোগসেবয়া –যোগ অনুষ্ঠানের দ্বারা, যত্র—যেখানে, চ - ও; এব - অবশ্যই, আত্মনা- শুদ্ধ মনের দ্বারা, আত্মানম্ - আত্মাকে, পশ্যম্— উপলব্ধি করে; আত্মনি—আত্মাতে, তুষ্যতি – তুষ্ট হয়।।২০।।
শ্লোক:21:
সুখমাত্যন্তিকং যত্তদ্ বুদ্ধি গ্রাহ্যমতীন্দ্রিয়ম্ ৷
বেত্তি যত্র ন চৈবায়ং স্থিতশ্চলতি তত্ত্বতঃ ॥২১॥
শব্দার্থঃ সুখম্ – সুখ, আত্যন্তিকম্— পরম্, যৎ– যা, তৎ– তা, বুদ্ধি - বুদ্ধি দ্বারা, গ্রাহ্যম্ - গ্রহণযোগ্য, অতীন্দ্রীয়ম্ - অপ্রাকৃত, বেত্তি—জানেন, যত্র - যেখানে, ন–না, চ– ও, এব - অবশ্যই, অয়ম্ — এই অবস্থায়, স্থিতঃ - অবস্থিত, চলতি - বিচলিত হন, তত্ত্বতঃ- আত্ম স্বরূপ থেকে।।২১।।
শ্লোক:22:
যং লব্ধ্বা চাপরং লাভং মন্যতে নাধিকং ততঃ ৷
যস্মিন্ স্থিতো ন দুঃখেন গুরুণাপি বিচাল্যতে ॥২২॥
শব্দার্থঃ যম্—যা, লব্ধা - অর্জনের মাধ্যমে, চ - ও, অপরম্ - অন্য কিছু, লাভম্ - লাভ, মন্যতে - মনে হয়, ন–না, অধিকম্ – অধিক, ততঃ– তার চেয়েও; যস্মিন্ - যাতে, স্থিতঃ—স্থিত হলে, ন - না, দুঃখেন - দুঃখের দ্বারা, গুরুণা অপি - যদিও খুব কঠিন, বিচাল্যতে–বিচলিত হয় ।।২২।।
শ্লোক:23:
তং বিদ্যাদ্দুঃখসংযোগবিয়োগং যোগসংজ্ঞিতম্ ॥২৩॥
শব্দার্থঃ তম্ - তা, বিদ্যাৎ - অবশ্যই জানবে, দুঃখসংযোগ— জড় জগতের সংযোগ-জনিত দুঃখ, বিয়োগম্ — বিয়োগ, যোগসংজ্ঞিতম্— যোগসমাধি বলা হয়।।২৩।।
অর্থ:- যোগ অভ্যাসের ফলে যে অবস্থায় চিত্ত সম্পূর্ণরূপে জড় বিষয় থেকে প্রত্যহৃত হয়, সেই অবস্থাকে যোগসমাধি বলা হয়। এই অবস্থায় শুদ্ধ অন্তঃকরণ দ্বারা আত্মাকে উপলব্ধি করে যোগী আত্মাতেই পরম আনন্দ আস্বাদন করেন। সেই আনন্দময় অবস্থায় অপ্রাকৃত ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অপ্রাকৃত সুখ অনুভূত হয়। এই পারমার্থিক চেতনায় অবস্থিত হলে যোগী আর আত্ম-তত্ত্বজ্ঞান থেকে বিচলিত হন না এবং তখন আর অন্য কোন কিছু লাভই এর থেকে অধিক বলে মনে হয় না। এই অবস্থায় স্থিত হলে চরম বিপর্যয়েও চিত্ত বিচলিত হয় না। জড় জগতের সংযোগ-জনিত সমস্ত দুঃখ-দুর্দশা থেকে এটিই হচ্ছে প্রকৃত মুক্তি।
শ্লোক:24:
স নিশ্চয়েন যোক্তব্যো যোগোহনির্বিণ্ণচেতসা ৷
সংকল্পপ্রভবান্ কামাংস্ত্যক্ত্বা সর্বানশেষতঃ ৷
মনসৈবেন্দ্রিয়গ্রামং বিনিয়ম্য সমন্ততঃ ॥২৪॥
শব্দার্থঃ সঃ—সেই যোগ, নিশ্চয়েন-অধ্যবসায় সহকারে, যোক্তব্যঃ - সাধন করা কর্তব্য, যোগ—যোগপদ্ধতি, অনির্বিন্ন চেতসা—অবিচলিতভাবে, সংকল্প - সংকল্প, প্রভবান্—জাত; কামান্ - কামনা, ত্যাগ — ত্যাগ করে; সর্বান্ - সমস্ত, অশেষতঃ —পূর্ণরূপে, মনসা—মনের দ্বারা, এব—অবশ্যই, ইন্দ্রিয়গ্রামম্—ইন্দ্রিয়সমুহকে; বিনিয়ম্য—নিয়ন্ত্রিত করে, সমন্ততঃ - সমস্ত দিক থেকে।
অর্থ:- অবিচলিত অধ্যবসায় ও বিশ্বাস সহকারে এই যোগ অনুশীলন করা উচিত৷ সংকল্পজাত সমস্ত কামনা সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করে মনের দ্বারা ইন্দ্রিয়গুলিকে সব দিক থেকে নিয়ন্ত্রিত করা কর্তব্য।
শ্লোক:25:
শনৈঃ শনৈরুপরমেদ্ বুদ্ধ্যা ধৃতিগৃহীতয়া ৷
আত্মসংস্থং মনঃ কৃত্বা ন কিঞ্চিদপি চিন্তয়েৎ ॥২৫॥
শব্দার্থঃ শনৈঃ শনৈঃ—ধীরে ধীরে, উপরমেৎ - নিবৃত্তি করে; বুদ্ধ্যা-বুদ্ধির দ্বারা, ধৃতিগৃহীতয়া—ধৈর্যযুক্ত, আত্মসংস্থম্ – চিন্ময় স্তরে স্থিত, মনঃ—মন, কৃত্বা - করে, ন—না; কিঞ্চিদপি—অন্য কোন কিছুই, চিন্তয়েৎ - চিন্তা করা উচিত।
অর্থ:- ধৈর্যযুক্ত বুদ্ধির দ্বারা মনকে ধীরে ধীরে আত্মাতে স্থির করে এবং অন্য কোন কিছুই চিন্তা না করে সমাধিস্থ হতে হয়।
শ্লোক:26:
যতো যতো নিশ্চলতি মনশ্চঞ্চলমস্থিরম্ ৷
ততস্ততো নিয়ম্যৈতদাত্মন্যেব বশং নয়েৎ ॥২৬॥
শব্দার্থঃ যতঃ যতঃ—যে যে বিষয়ে, নিশ্চলতি—অত্যন্ত বিচলিত হয়; মনঃ—মন; চঞ্চলম্– চঞ্চল; অস্থিরম্ - অস্থির, ততঃ ততঃ—সেই সেই বিষয় থেকে, নিয়ম্য— নিয়ন্ত্রিত করে, এতৎ - এই, আত্মনি— আত্মাতে, এব - অবশ্যই, বশম্—বশে; নয়েৎ—আনবে।
অর্থ:- চঞ্চল ও অস্থির মন যে যে বিষয়ে ধাবিত হয়, সেই সেই বিষয় থেকে নিবৃত্ত করে আত্মার বসে আনতে হবে।
শ্লোক:27:
প্রশান্তমনসং হ্যেনং যোগিনং সুখমুত্তমম্ ৷
উপৈতি শান্তরজসং ব্রহ্মভূতমকল্মষম্ ॥২৭॥
শব্দার্থঃ প্রশান্ত—প্রশান্ত, শ্রীকৃষ্ণের শ্রীপাদপদ্মে নিবিষ্ট; মনসম্— যাঁর মন, হি— নিশ্চিতভাবে; এনম্—এই, যোগিনম্ — যোগী; সুখম্ - সুখ, উত্তমম্ – সর্বোত্তম উপৈতি—প্রাপ্ত হন, শান্তরজসম্ — রজগুণ প্রশমিত, ব্রহ্মভূতম্- ব্রহ্মভাব সম্পন্ন, অকল্মষম্ — নিষ্পাপ।
অর্থ:- ব্রহ্মভাব-সম্পন্ন, প্রশান্ত চিত্ত, রজগুণ প্রশমিত ও নিষ্পাপ হয়ে যাঁর মন আমাতে নিবিষ্ট হয়েছে, তিনিই পরম সুখ প্রাপ্ত হন।
শ্লোক:28:
যুঞ্জন্নেবং সদাত্মানং যোগী বিগতকল্মষঃ ৷
সুখেন ব্রহ্মসংস্পর্শমত্যন্তং সুখমশ্নুতে ॥২৮॥
শব্দার্থঃ যুঞ্জন – যোগযুক্ত হয়ে, এবম্—এভাবে, সদা - সর্বদা, আত্মানম্ – আত্মাকে, যোগী—যিনি পরম আত্মার সঙ্গে যুক্ত, বিগত —মুক্ত; কল্মষঃ—সর্বপ্রকার জড় কলুষ থেকে; সুখেন—চিন্নয় সুখে, ব্রহ্মসংস্পর্শম্ – পরব্রহ্মার সঙ্গে নিরন্তর যুক্ত হয়ে, অত্যন্তম্ – পরম, সুখম্– সুখ, অশ্নুতে—লাভ করেন।
অর্থ:- এভাবেই আত্মসংযমী যোগী জড় জগতের সমস্ত কলুষ থেকে মুক্ত হয়ে ব্রহ্ম- সংস্পর্শরূপ পরম সুখ আস্বাদন করেন।
শ্লোক:29:
সর্বভূতস্থমাত্মানং সর্বভূতানি চাত্মনি ৷
ঈক্ষতে যোগযুক্তাত্মা সর্বত্র সমদর্শনঃ ॥২৯॥
শব্দার্থঃ সৰ্বভূতস্থম—সমস্ত প্রাণীতে স্থিত, আত্মানম্ পরমাত্মাকে, সর্ব - সমস্ত, ভূতানি— জীব, চ–ও, আত্মনি— আত্মায়, ঈক্ষতে– দর্শন করেন; যোগযুক্তারা - কৃষ্ণভাবনায় যুক্ত, সর্বত্র—সর্বত্র, সমদর্শনঃ—সমদর্শন।
অর্থ:- প্রকৃত যোগী সর্বভূতে আমাকে দর্শন করেন এবং আমাতে সব কিছু দর্শন করেন৷ যোগযুক্ত আত্মা সর্বত্রই আমাকে দর্শন করেন ।
শ্লোক:30:
যো মাং পশ্যতি সর্বত্র সর্বং চ ময়ি পশ্যতি ৷
তস্যাহং ন প্রণশ্যামি স চ মে ন প্রণশ্যতি ॥৩০॥
শব্দার্থঃ যঃ - যিনি, মাম্ – আমাকে, পশ্যতি – দর্শন করেন, সর্বত্র—সর্বত্র, সর্বম্—সব কিছু, চ―এবং; ময়ি— আমাতে, পশ্যতি - দর্শন করেন, তস্য— তাঁর, অহম্ - আমি, ন— না: প্রণশ্যামি—হারিয়ে যাই, সঃ– তিনি, চ–ও, মে - আমার,ন - না, প্রণশ্যতি— হারিয়ে যান।
অর্থ:- যিনি সর্বত্র আমাকে দর্শন করেন এবং আমাতেই সমস্ত বস্তু দর্শন করেন, আমি কখনও তাঁর দৃষ্টির অগোচর হই না এবং তিনিও আমার দৃষ্টির অগোচর হন না।
শ্লোক:31:
সর্বভূতস্থিতং যো মাং ভজত্যেকত্বমাস্থিতঃ ৷
সর্বথা বর্তমানোহপি স যোগী ময়ি বর্ততে ॥৩১॥
শব্দার্থঃ সর্বভূতস্থিতমম্ — সমস্ত জীবের হৃদয়ে অবস্থিত, যঃ— যিনি, মাম্ - আমাকে, ভজতি—ভজনা করেন, একত্বম্ - অভিন্নরূপে, আস্থিতঃ— আশ্রয়পূর্বক। সর্বথা— সর্বতোভাবে,বর্তমান - অবস্থিত হয়ে, অপি— সত্ত্বেও, সঃ - তিনি, যোগী—যোগী, ময়ি—আমাতে, বৰ্ততে - অবস্থান করেন।
অর্থ:- যে যোগী সর্বভূতে স্থিত পরমাত্মা রূপে আমাকে জেনে আমার ভজনা করেন, তিনি সর্ব অবস্থাতেই আমাতে অবস্থান করেন।
শ্লোক:32:
আত্মৌপম্যেন সর্বত্র সমং পশ্যতি যোহর্জুন ৷
সুখং বা যদি বা দুঃখং স যোগী পরমো মতঃ ॥৩২॥
শব্দার্থঃ আত্ম—নিজের, ঔপম্যেন— তুলনার দ্বারা, সর্বত্র—সর্বত্র, সমম্ - সমভাবে, পশ্যতি—দর্শন করেন, যঃ - যিনি, অর্জুন – হে অর্জুন, সুখ - সুখ, বা - অথবা, যদি—যদি, বা — অথবা, দুঃখ-দুঃখ, সঃ—সেই, যোগী—যোগী, পরমঃ - সর্বশ্রেষ্ঠ, মতঃ—মনে করা হয়।
অর্থ:- হে অর্জুন ! যিনি সমস্ত জীবের সুখ ও দুঃখকে নিজের সুখ ও দুঃখের অনুরূপ সমানভাবে দর্শন করেন, আমার মতে তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী।
শ্লোক:33:
অর্জুন উবাচঃ
যোহয়ং যোগোস্ত্বয়া প্রোক্তঃ সাম্যেন মধুসূদন ৷
এতস্যাহং ন পশ্যামি চঞ্চলত্বাৎ স্থিতিং স্থিরাম্ ॥৩৩॥
শব্দার্থঃ অর্জুনঃ উবাচ—অর্জুন বললেন, যঃ অয়ম্—এই পদ্ধতি, যোগঃ—যোগ, ত্বয়া - তোমার দ্বারা, প্রোক্তঃ - বর্ণিত হল; সাম্যেন—সমদর্শনরূপ, মধুসূদন— হে মধুসুদন; এতস্য–এর, অহম্ - আমি, ন - না, পশ্যামি— দেখি, চঞ্চলা – চাঞ্চল্যবশত, স্থিতিম্—স্থিতি, স্থিরাম্—স্থায়ী।
অর্থ:- অর্জুন বললেন- হে মধুসূদন ! তুমি সর্বত্র সমদর্শনরূপ যে যোগ উপদেশ করলে, মনের চঞ্চল স্বভাববশত আমি তার স্থায়ী স্থিতি দেখতে পাচ্ছি না।
শ্লোক:34:
চঞ্চলং হি মনঃ কৃষ্ণ প্রমাথি বলবদ্দৃঢ়ম্ ৷
তস্যাহং নিগ্রহং মন্যে বায়োরিব সুদুষ্করম্ ॥৩৪॥
শব্দার্থঃ চঞ্চলম্–চঞ্চল; হি—নিশ্চিতভাবে, মনঃ—মন, কৃষ্ণ – হে কৃষ্ণ, প্রমাথি— বিক্ষোভকর, বলবৎ—বলবান, দৃঢ়ম্ - দুর্দমনীয়। তস্য— তার, অহম্ - আমি, নিগ্রহম্ - নিগ্রহ, মন্যে - মনে করি, বায়োঃ, বায়ুর, ইব— মতো সুদুষ্করম্ – সুকঠিন।
অর্থ:- হে কৃষ্ণ! মন অত্যন্ত চঞ্চল, শরীর ও ইন্দ্রিয় আদির বিক্ষেপ উৎপাদক, দুর্দমনীয় এবং অত্যন্ত বলবান, তাই তাকে নিগ্রহ করা বায়ুকে বশীভূত করার থেকেও অধিকতর কঠিন বলে আমি মনে করি৷
শ্লোক:35:
শ্রীভগবানুবাচঃ
অসংশয়ং মহাবাহো মনো দুর্নিগ্রহং চলম্ ৷
অভ্যাসেন তু কৌন্তেয় বৈরাগ্যেণ চ গৃহ্যতে ॥৩৫॥
শব্দার্থঃ শ্রীভগবান উবাচ- পরমেশ্বর ভগবান বললেন, অসংশয়ম্ – সন্দেহ নেই; - মহাবাহো– হে মহাবীর, মনঃ—মন, দুর্নিগ্ৰহম্— দুর্দমনীয়, চলম্ – চঞ্চল, অভ্যাসেন অভ্যাসের দ্বারা, তু– কিন্তু, কৌন্তেয় – হে কুম্ভীপুত্ৰ, বৈরাগ্যেণ— বৈরাগ্যের দ্বারা; চ–ও, গৃহ্যতে - বশীভূত করা সম্ভব।
অর্থ:- পরমেশ্বর ভগবান বললেন- হে মহাবাহো! মন যে দুর্দমনীয় ও চঞ্চল তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু হে কৌন্তেয়! ক্রমশ অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা মনকে বশীভূত করা যায়।
শ্লোক:36:
অসংযতাত্মনা যোগো দুষ্প্রাপ ইতি মে মতিঃ ৷
বশ্যাত্মনা তু যততা শক্যোহবাপ্তুমুপায়তঃ ॥৩৬॥
শব্দার্থঃ অসংযত - অসংযত, আত্মনা—মনের দ্বারা, যোগঃ - আত্ম-উপলব্ধি, দুষ্প্রাপঃ - দুষ্প্রাপ্য, ইতি—এভাবে, মে—আমার, মতিঃ— অভিমত, বশ্য - বশীভুত, আত্মনা – মনের দ্বারা; তু— কিন্তু, যততা—যত্নবান, শক্যঃ — সমর্থ, অব্যপ্তম্ — লাভ করতে: উপায়তঃ—যথার্থ উপায় অবলম্বন করে।
অর্থ:- অসংযত চিত্ত ব্যাক্তির পক্ষে আত্ম-উপলব্ধি দুষ্প্রাপ্য৷ কিন্তু যার মন সংযত এবং যিনি যথার্থ উপায় অবলম্বন করে মনকে বশ করতে চেষ্টা করেন, তিনি অবশ্যই সিদ্ধি লাভ করেন। সেটিই আমার অভিমত৷
শ্লোক:37:
অর্জুন উবাচঃ
অযতিঃ শ্রদ্ধয়োপেতো যোগাচ্চলিতমানসঃ ৷
অপ্রাপ্য যোগসংসিদ্ধিং কাং গতিং কৃষ্ণ গচ্ছতি ॥৩৭॥
শব্দার্থঃ অর্জুনঃ উবাচ—অর্জুন বললেন; অয়তিঃ - ব্যর্থ যোগী, শ্ৰদ্ধয়া-শ্রদ্ধা সহকারে; উপেতঃ—যুক্ত, যোগাৎ - যোগ থেকে, চলিত - ভ্রষ্ট, মানসঃ– চিত্ত। অপ্রাপ্য – না পেয়ে, যোগসংসিদ্ধিম্ – যোগের সম্যক ফল: কাম্ – কি, গতিম্ – গতি, কৃষ্ণ – হে কৃষ্ণ, গচ্ছতি—প্রাপ্ত হন।
অর্থ:- অর্জুন জিজ্ঞাসা করলেন- হে কৃষ্ণ ! যিনি প্রথমে শ্রদ্ধা সহকারে যোগে যুক্ত থেকে পরে চিত্তচাঞ্চল্য হেতু ভ্রষ্ট হয়ে যোগে সিদ্ধিলাভ করতে না পারেন, তবে সেই ব্যর্থ যোগীর কি গতি লাভ হয় ?
শ্লোক:38:
কচ্চিন্নোভয়বিভ্রষ্টশ্ছিন্নাভ্রমিব নশ্যতি ৷
অপ্রতিষ্ঠো মহাবাহো বিমূঢ়ো ব্রহ্মণঃ পথি ॥৩৮॥
শব্দার্থঃ কচ্চিৎ—কি, ন–না; উভয়—উভয়, বিভ্রষ্টঃ - ভ্রষ্ট, ছিন্ন - ছিন্ন অভ্রম্ – মেঘ; ইব - মতো; নশ্যতি — নষ্ট হয়, অপ্রতিষ্ঠা—নিরাশ্রয়, মহাবাহো - হে মহাবীর কৃষ্ণ, বিমুঢ়ঃ — বিমুঢ়, ব্রহ্মণঃ - ব্রহ্ম লাভের, পথি - পথে।
অর্থ:- হে মহাবাহো কৃষ্ণ ! কর্ম ও যোগ হতে ভ্রষ্ট ব্যাক্তি ব্রহ্ম লাভের পথ থেকে বিমূঢ় হয়ে অপ্রতিষ্ঠ হয়ে যে আশ্রয়্হীন হয়ে পড়ে, সে কি ছিন্ন মেঘের মতো একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে?
শ্লোক:39:
এতন্মে সংশয়ং কৃষ্ণ ছেত্তুমর্হস্যশেষতঃ ৷
ত্বদন্যঃ সংশয়স্যাস্য ছেত্তা ন হ্যুপপদ্যতে ॥৩৯॥
শব্দার্থঃ এতৎ—এই, মে—আমার, সংশয়ম্ – সংশয়, কৃষ্ণ – হে কৃষ্ণ, ছেত্তুম্ —দূর করতে, অর্হসি—তুমি সমর্থ, অশেষতঃ - সর্বতোভাবে, ত্বৎ– তুমি ছাড়া, অন্যঃ — অন্য কেউ; সংশয়স্য সংশয়ের, অস্য - এই, ছেত্তা - ছেদনকারী ন - না; হি - অবশ্যই, উপপদ্যতে—পাওয়া যাবে।
অর্থ:- হে কৃষ্ণ ! তুমিই কেবল আমার এই সংশয় দূর করতে সমর্থ। কারণ তুমি ছাড়া আর কেউই আমার এই সংশয় দূর করতে পারবে না।
শ্লোক:40:
শ্রীভগবানুবাচঃ
পার্থ নৈবেহ নামুত্র বিনাশস্তস্য বিদ্যতে ৷
ন হি কল্যাণকৃৎ কশ্চিদ্ দুর্গতিং তাত গচ্ছতি ॥৪০॥
শব্দার্থঃ শ্রীভগবান্ উবাচ–পরমেশ্বর ভগবান বললেন; পাৰ্থ – হে পৃথাপুত্ৰ, নৈৰ - কখনও এই রকম হয় না: ইহ—এই জড় জগতে; ন–না, অমুত্র - পরলোকে, বিনাশঃ —বিনাশ; তস্য—তার; বিদ্যতে– বিদ্যমান, ন - না, হি—যেহেতু, কল্যাণকৃৎ - শুভ অনুষ্ঠানকারী; কশ্চিৎ – কেউই, দুর্গতিম্ – দুর্গতি, তাত–হে বত্স; গচ্ছতি – প্রাপ্ত হয়।
অর্থ:- পরমেশ্বর ভগবান বললেন- হে পার্থ! শুভানুষ্ঠানকারী পরমার্থবিদের ইহলোকে ও পরলোকে কোন দুর্গতি হয় না৷ হে বৎস! তার কারণ, কল্যাণকারীর কখনও অধোগতি হয় না।
শ্লোক:41:
প্রাপ্য পুণ্যকৃতাং লোকানুষিত্বা শাশ্বতীঃ সমাঃ৷
শুচীনাং শ্রীমতাং গেহে যোগভ্রষ্টোহভিজায়তে ॥৪১॥
শব্দার্থঃ প্রাপ্য- লাভ করে, পুণ্যকৃতাম্ - পুণ্যবানদের, লোকান্ - লোকসমূহ, ঊষিত্বা – বাস করে, শাশ্বতীঃ—বহু, সমাঃ - বৎসর, শুচীনাম্ - সদাচারী, শ্রীমতাম্ - ধনীর, গেহে–গৃহে যোগভ্রষ্ট: - যোগ থেকে বিচ্যুত ব্যক্তি, অভিজায়তে - জন্মগ্রহণ করেন।
অর্থ:- যোগভ্রষ্ট ব্যক্তি পুণ্যবানদের প্রাপ্য স্বর্গাদি লোকসমূহে বহুকাল বাস করে সদাচারী ব্রাহ্মণদের গৃহে অথবা শ্রীমান ধনী বণিকদের গৃহে জন্মগ্রহণ করেন।
শ্লোক:42:
অথবা যোগিনামেব কুলে ভবতি ধীমতাম্ ৷
এতদ্ধি দুর্লভতরং লোকে জন্ম যদীদৃশম্ ॥৪২॥
শব্দার্থঃ অথবা— অথবা, যোগিনাম্ – যোগিদের, এব—অবশ্যই, কুলে - বংশে, ভবতি— জন্মগ্রহণ করেন; ধীমতাম্ - জ্ঞানবান, এতৎ—এই; হি— অবশ্যই, দুর্লভতরম্— অত্যন্ত দুর্লভ, লোকে— এই জগতে, জন্ম– জন্ম,যৎ - যে, ঈদৃশম্ - এই প্রকার।
অর্থ:- অথবা যোগভ্রষ্ট পুরুষ জ্ঞানবান যোগীগণের বংশে জন্মগ্রহণ করেন। এই প্রকার জন্ম এই জগতে অবশ্যই অত্যন্ত দুর্লভ।
শ্লোক:43:
তত্র তং বুদ্ধিসংযোগং লভতে পৌর্বদেহিকম্ ৷
যততে চ ততো ভূয়ঃ সংসিদ্ধৌ কুরুনন্দন॥৪৩॥
শব্দার্থঃ তত্র—তার ফলে; ত্বম্— সেই, বুদ্ধিসংযোগম্— পরমাত্ম-বিষয়িণী বুদ্ধির সঙ্গে সংযোগ, লভতে—লাভ করেন, পৌর্ব–পূর্ব, দেহিকম্– জন্মকৃত, যততে– যত্ন করেন, চ–ও, ততঃ— তারপর, ভূয়ঃ— পুনরায়; সংসিদ্ধৌ– সিদ্ধি লাভের জন্য; কুরুনন্দন—হে কুরুপুত্র।
অর্থ:- হে কুরুনন্দন ! সেই প্রকার জন্মগ্রহণ করার ফলে তিনি পুনরায় তাঁর পুর্ব জন্মকৃত পারমার্থিক চেতনার বুদ্ধিসংযোগ লাভ করে সিদ্ধি লাভের জন্য পুনরায় যত্নবান হন।
শ্লোক:44:
পূর্বাভ্যাসেন তেনৈব হ্রিয়তে হ্যবশোহপি সঃ ৷
জিজ্ঞাসুরপি যোগস্য শব্দব্রহ্মাতিবর্ততে ॥৪৪॥
শব্দার্থঃ পূর্ব–পূর্ব, অভ্যাসেন — অভ্যাসের দ্বারা, তেন— সেভাবে; এব–অবশ্যই: হ্রিয়তে - আকৃষ্ট হন; হি— নিশ্চিতভাবে, অবশঃ — অবশ হয়ে, অপি–ও, সঃ– তিনি; জিজ্ঞাসুঃ—জানতে ইচ্ছুক, অপি - এমন কি, যোগস্য – যোগের; শব্দব্রহ্ম–বেদোক্ত কর্মমাগ: অতিবর্ততে—অতিক্রম করেন।
অর্থ:- তিনি পূর্ব জন্মের অভ্যাস বশে যেন অবশ হয়ে যোগ-সাধনের প্রতি আকৃষ্ট হন। এই প্রকার যোগশাস্ত্রের জিজ্ঞাসু পুরুষ বেদোক্তসকাম কর্মমার্গকে অতিক্রম করেন, অর্থাৎসকাম কর্মমার্গে যে ফল নিদৃষ্ট আছে, তার থেকে উৎকৃষ্ট ফল লাভ করেন।
শ্লোক:45:
প্রযত্নাদ্ যতমানস্তু যোগী সংশুদ্ধকিল্বিষঃ ৷
অনেকজন্মসংসিদ্ধস্ততো যাতি পরাং গতিম্ ॥৪৫॥
শব্দার্থঃ প্রযত্নাৎ—যত্ন অপেক্ষা, যতমানঃ – যত্নবান ভতু– কিন্তু, যোগী—এই প্রকার যোগী; সংশুদ্ধ - বিশুদ্ধ, কিল্বিষঃ - সর্বপ্রকার পাপ; অনেক - বহু, জন্ম - জন্ম, সংসিদ্ধ – সিদ্ধি লাভ করে, ততঃ - তারপর, যাতি - লাভ করেন, পরাম্ - পরম, গতিম্—গতি।
অর্থ:- যোগী ইহজন্মে পূর্বজন্মকৃত যত্ন অপেক্ষা অধিকতর যত্ন করে পাপ মুক্ত হয়ে পূর্ব পূর্ব জন্মের সাধন সঞ্চিত সংস্কার দ্বারা সিদ্ধি লাভ করে পরম গতি লাভ করেন।
শ্লোক:46:
তপস্বিভ্যোহধিকো যোগী জ্ঞানিভ্যোহপি মতোহধিকঃ ৷
কর্মিভ্যশ্চাধিকো যোগী তস্মাদ্ যোগী ভবার্জুন ॥৪৬॥
শব্দার্থঃ তপস্থিভ্যঃ—তপস্বীদের চেয়ে, অধিকঃ – শ্ৰেষ্ঠ, যোগী - যোগী, জ্ঞানিভ্যঃ— জ্ঞানীদের চেয়ে, অপি – ও, মতঃ — মত, অধিক - শ্রেষ্ঠ কর্মিভ্যঃ—সতাম কর্মীদের চেয়ে চ–ও অধিক শ্রেষ্ঠ যোগী যোগী, জন্মাৎ অতএব; যোগী—যোগী; ভব—হও, অর্জুন-হে অর্জুন।
অর্থ:- যোগী তপস্বীদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, জ্ঞানীদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং সকাম কর্মীদের চেয়েও শ্রেষ্ঠ ৷ অতএব, হে অর্জুন! সর্ব অবস্থাতেই তুমি যোগী হও।
শ্লোক:47:
যোগিনামপি সর্বেষাং মদ্ গতেনান্তরাত্মনা ৷
শ্রদ্ধাবান্ ভজতে যো মাং স মে যুক্ততমো মতঃ ॥৪৭॥
শব্দার্থঃ যোগিনাম—যোগীদের; অপি–ও; সর্বেবাম্ - সর্বপ্রকার: মদগতেন - আমাতেই আসক্ত; অন্তরাত্মনা—অন্তরে সব সময় আমার কথ চিন্তা করে, শ্রদ্ধাবান্—পূর্ণ বিশ্বাস সহকারে; ভজতে - ভজনা করেন; যঃর্ট– যিনি; মাম্ আমাকে (পরমেশ্বর ভগবানকে); সঃ—তিনি, মে –আমার, যুক্ততমঃ - সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, মতঃ - অভিমত।
অর্থ:- যিনি শ্রদ্ধা সহকারে মদ্ গত চিত্তে আমার ভজনা করেন, তিনিই সবচেয়ে অন্তরঙ্গভাবে আমার সঙ্গে যুক্ত এবং তিনিই সমস্ত যোগীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। সেটিই আমার অভিমত৷
ওঁ তৎসদিতি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসূপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জুনসংবাদে 'আত্ম-সংযমযোগো' নামক ষষ্ঠোঽধ্যায়ঃ সমাপ্তম্।
Post a Comment