Header Ads


অষ্টম অধ্যায় - অক্ষর-ব্রহ্ম-যোগ

অষ্টম অধ্যায়

ওঁ তৎ সৎ

শ্রীমদ্ভগবদ গীতা

ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়ঃ

অষ্টম অধ্যায় - অক্ষরব্রহ্ম যোগ


শ্লোক:1:

অর্জুন উবাচঃ

কিং তদ্ ব্রহ্ম কিমধ্যাত্মং কিং কর্ম পুরুষোত্তম।

অধিভূতং চ কিং প্রোক্তম অধিদৈবং কিমুচ্যতে ॥১॥

শব্দার্থঃ অর্জুনঃ উবাচ—অর্জুন বললেন, কিম—কি; তৎ—সেই, ব্রহ্ম —ব্রহ্ম, কিম্—কি, অধ্যাত্মম্— আত্মা; কিম্ – কি, কর্ম-কর্ম, পুরুষোত্তম—হে পুরুষোত্তম: অধিভূতম্—জড়-জাগতিক প্রকাশ, চ — এবং, কিম্—কি, প্রোক্তম—বলা হয়; অধিদৈবম্—দেবতাগণ, কিম্ – কি; উচ‍্যতে - বলা হয়।

অনুবাদ:- অর্জুন জিজ্ঞাসা করলেন- হে পুরুষোত্তম! ব্রহ্ম কি? অধ্যাত্ম কি? কর্ম কি? অধিভূত ও অধিদৈবই বা কাকে বলে? অনুগ্রহপূর্বক আমাকে স্পষ্ট করে বল।


শ্লোক:2:

অধিযজ্ঞঃ কথং কোহত্র দেহেহস্মিন্মধুসূদন ।

প্রয়াণকালে চ কথং জ্ঞেয়োহসি নিয়তাত্মভিঃ॥২॥

শব্দার্থঃ অধিযজ্ঞঃ—যজ্ঞের অধিষ্ঠাতা; কথম্—কিভাবে, কঃ—কে; অত্র - এখানে, দেহে—শরীরে, অস্মিন্ —এই; মধুসূদন— হে মধুসুদন। প্রয়াণকালে— মৃত্যুর সময়; চ–এবং, কথম – কিভাবে, জ্ঞেয়ঃ—জ্ঞাত অসি - হও, নিয়তাত্মভিঃ—আত্ম সংযমীর দ্বারা।

অনুবাদ:- হে মধুসূদন ! এই দেহে অধিযজ্ঞ কে, এবং এই দেহের মধ্যে তিনি কিরূপে অবস্থিত? মৃত্যুকালে জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তিরা কিভাবে তোমাকে জানতে পারেন?


শ্লোক:3:

শ্রীভগবানুবাচঃ

অক্ষরং ব্রহ্ম পরমং সভাবোহধ্যাত্মমুচ্যতে ।

ভূতভাবোদ্ভবকরো বিসর্গঃ কর্মসংজ্ঞিতঃ ॥৩॥

শব্দার্থঃ শ্রীভগবান উবাচ—পরমেশ্বর ভগবান বললেন; অক্ষরম্ - বিনাশ রহিত, ব্ৰহ্ম - ব্ৰহ্ম, পরমম্—পরম, স্বভাবঃ — নিত্য স্বভাব, অধ্যাত্মম্ - অধ্যাত্ম, উচ্যতে—বলা হয়; ভূতভাবোদ্ভবকরঃ– জীবের জড় দেহের উৎপত্তিকর, বিসর্গঃ—সৃষ্টি, কর্ম - কর্ম সংজ্ঞিতঃ - কথিত হয়।

অনুবাদ:-পরমেশ্বর ভগবান বললেন- নিত্য বিনাশ-রহিত জীবকে বলা হয় ব্রহ্ম এবং তার নিত্য স্বভাবকে অধ্যাত্ম বলে। ভূতগণের উৎপত্তি ও বৃদ্ধিকর সংসারই কর্ম।

শ্লোক:4:

অধিভূতং ক্ষরো ভাবঃ পুরুষশ্চাধিদৈবতম্ ।

অধিযজ্ঞোহহমেবাত্র দেহে দেহভৃতাং বর ॥৪॥

শব্দার্থঃ অধিভূতম্—অধিভূত; ক্ষরঃ—নিয়ত পরিবর্তনশীল:, ভাবঃ—ভাব; পুরুষঃ—সূর্য, চন্দ্র আদি সমস্ত দেবতাদের সমষ্টিরূপ বিরাট পুরুষ; চ–এবং, অধিদৈবতম্– অধিদৈব বলা হয়; অধিযজ্ঞঃ - পরমাত্মা; অহম্— আমি (শ্রীকৃষ্ণ); এব—অবশ্যই; অত্র - এই, দেহে - শরীরে; দেহভৃতাম্ - দেহধারীদের মধ্যে; বর— শ্রেষ্ঠ।

অনুবাদ:- হে দেহ্ধারীশ্রেষ্ঠ ! নশ্বর জড়া প্রকৃতি অধিভূত। সূর্য, চন্দ্র আদি সমস্ত দেবতাদের সমষ্টিরূপ বিরাট পুরুষকে অধিদৈব বলা হ্য়। আর দেহীদের দেহান্তরগত অন্তর্যামী রূপে আমিই অধিযজ্ঞ।


শ্লোক:5:

অন্তকালে চ মামেব স্মরন্মুক্ত্বা কলেবরম্ ।

যঃ প্রয়াতি স মদ্ভাবং যাতি নাস্ত্যত্র সংশয়ঃ ॥৫॥

শব্দার্থঃ অন্তকালে— অন্তিম সময়ে, চ–ও, মাম্ —আমাকে; এৰ– অবশ্যই; স্মরন্— স্মরণ করে; মুক্তা— ত্যাগ করে; কলেবরম্ - দেহ; যঃ—যিনি; প্রয়াতি—প্রয়াণ করেন; সঃ– তিনি; মদ্ভাবম্— আমার স্বভাব; যাতি - লাভ করেন; নাস্তি—নেই; অত্র - এখানে, সংশয়ঃ— সন্দেহ।

অনুবাদ:- মৃত্যুর সময় যিনি আমাকে স্মরণ করে দেহত্যাগ করেন, তিনি তৎক্ষণাৎ আমার ভাবই প্রাপ্ত হন। এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।


শ্লোক:6:

যং যং বাপি স্মরন্ ভাবং ত্যজত্যন্তে কলেবরম্ ।

তং তমেবৈতি কৌন্তেয় সদা তদ্ভাবভাবিতঃ ॥৬॥

শব্দার্থঃ যম্ যম্—যেমন যেমন; বা–বা; অপি–ও; স্মরন্ — স্মরণ করে; ভাবম্ - ভাব; ত্যজতি—ত্যাগ করেন; অন্তে— অন্তিমকালে; কলেবরম্ – দেহ। তম্ তম্—সেই সেই; এব—অবশ্যই; এতি—প্রাপ্ত হন; কৌন্তেয়— হে কুন্তীপুত্র; সদা-সর্বদা; তৎ—সেই; ভাব—ভাব; ভাবিতঃ— তন্ময়চিত্ত।

অনুবাদ:- অন্তিমকালে যিনি যে ভাব স্মরণ করে দেহত্যাগ করেন, তিনি সেই ভাবে ভাবিত তত্ত্বকেই লাভ করেন।


শ্লোক:7:

তস্মাৎ সর্বেষু কালেষু মামনুস্মর যুধ্য চ ।

ময্যর্পিতমনোবুদ্ধির্মামেবৈষ্যস্যসংশয়ঃ ॥৭॥

শব্দার্থঃ তস্মাৎ— অতএব; সর্বেষু - সব; কালেষু—সময়ে; মাম—আমাকে, অনুস্মর— স্মরণ করে: যুধ্য—যুদ্ধ কর; চ–ও; ময়ি—আমাতে; অর্পিত—সমর্পিত হলে; মনঃ— মন; বুদ্ধি–বুদ্ধি; মাম্ — আমাকে; এব–অবশ্যই; এষ‍্যসি—পারে; অসংশয়ঃ - নিঃসন্দেহে।

অনুবাদ:- অতএব, হে অর্জুন ! সর্বদা আমাকে স্মরণ করে তোমার স্বভাব বিহিত যুদ্ধ কর, তা হলে আমাতে তোমার মন ও বুদ্ধি অর্পিত হবে এবং নিঃসন্দেহে তুমি আমাকেই লাভ করবে।


শ্লোক:8:

অভ্যাসযোগযুক্তেন চেতসা নান্যগামিনা ।

পরমং পুরুষং দিব্যং যাতি পার্থানুচিন্তয়ন্ ॥৮॥

শব্দার্থঃ অভ্যাস—অভ্যাস; যোগযুক্তেন—যোগে যুক্ত হয়ে, চেতসা—মন ও বুদ্ধির দ্বারা; ন অন্যগামিনা— অনন্যগামী; পরমম্ - পরম; পুরুষম্ — পুরুষকে; দিব‍্যম্ — দিব‍্য; যাতি— প্রাপ্ত হন; পার্থ–হে পৃথাপুত্র; অনুচিন্তয়ন্— অনুক্ষণ চিন্তা করে।

অনুবাদ:- হে পার্থ ! অভ্যাস যোগে যুক্ত হয়ে অনন্যগামী চিত্তে যিনি অনুক্ষণ পরম পুরুষের চিন্তা করেন, তিনি অবশ্যই তাঁকেই প্রাপ্ত হবেন।


শ্লোক:9:

কবিং পুরাণমনুশাসিতারম্ অণোরনিয়াংসমনুস্মরেদ্ যঃ ।

সর্বস্য ধাতারমচিন্ত্যরূপম্ আদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ ॥৯॥

শব্দার্থঃ কবিম্ — সর্বজ্ঞ, পুরাণম্ - অনাদি: অনুশাসিতারম্ - নিয়ন্তা, অণোঃ - সূক্ষ্ম থেকে, অর্ণীয়াংসম্–সূক্ষ্মতর; অনুস্মরেৎ—নিরন্তর স্মরণ করেন; সঃ– যিনি, সর্বসা—সব কিছুর; ধাতারম্—বিধাতা; অচিন্ত্য-অচিন্ত্য, রূপম্—রূপ, আদিত্যবর্ণম-সূর্যের মতো জ্যোতির্ময়; তমসঃ– অন্ধকারের, পরস্তাৎ— অতীত।

অনুবাদ:- সর্বজ্ঞ, সনাতন, নিয়ন্তা, সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর, সকলের বিধাতা, জড় বুদ্ধির অতীত, অচিন্ত্য ও পুরুষরূপে পরমেশ্বর ভগবানের ধ্যান করা উচিত। তিনি সূর্যের মতো জোর্তিময় এবং এই জড়া প্রকৃতির অতীত।


শ্লোক:10:

প্রয়াণকালে মনসাচলেন ভক্ত্যা যুক্তো যোগবলেন চৈব ।

ভ্রুবোর্মধ্যে প্রাণমাবেশ্য সম্যক্ স তং পরং পুরুষমুপৈতি দিব্যম্ ॥১০॥

শব্দার্থঃ প্রয়াণকালে - মৃত্যুর সময়; মনসা-মনের দ্বারা, অচলেন - অচঞ্চলভাবে, ভক্ত্যা - ভক্তি সহকারে; যুক্তঃ– সংযুক্ত, যোগবলেন- যোগশক্তির বলে, চ–ও, এব - অবশ্যই। ভ্রুবোঃ—ভ্রূযুগল: মধ্যে - মধ্যে, প্রাণম্—প্রাণবায়ুকে, আবেশ্য–স্থাপন করে; সম্যক্‌ – সম্পূর্ণরূপে; সঃ - তিনি; তম্ – সেই; পরম্ - পরম; পুরুষম্ - পুরুষকে; উপৈতি—প্রাপ্ত হন; দিব্যম্‌—দিব‍্য।

অনুবাদ:- যিনি মৃত্যুর সময় অচঞ্চল চিত্তে, ভক্তিসহকারে, পূর্ণ যোগশক্তির বলে ভ্রুযুগলের মধ্যে প্রাণবায়ুকে স্থাপন করে পরমেশ্বর ভগবানকে স্মরণ করেন, তিনি অবশ্যই সেই দিব্য পরম পুরুষকে প্রাপ্ত হন।


শ্লোক:11:

যদক্ষরং বেদবিদো বদন্তি বিশন্তি যদ্ যতয়ো বীতরাগাঃ ।

যদিচ্ছন্তো ব্রহ্মচর্যং চরন্তি তত্তে পদং সংগ্রহেণ প্রবক্ষ্যে ॥১১॥

শব্দার্থঃ যৎ—যাঁকে; অক্ষরম্– অবিনাশী; বেদবিদঃ—বেদবিৎ, বদন্তি - বলেন, বিশন্তি - প্রবেশ করেন; যৎ—যাতে; যতয়ঃ— সন্ন্যাসীগণ; বীতরাগাঃ—বিষয়ে আসক্তিশুন‍্য; যৎ—যাঁকে; ইচ্ছন্তঃ—ইচ্ছা করে; ব্রহ্মচর্যম্ - ব্রহ্মচর্য, চরন্তি - পালন করেন; তৎ– সেই; তে—তোমাকে; পদম্ — পদ; সংগ্রহেণ— সংক্ষেপে, প্রবক্ষ্যে - বলব।

অনুবাদ:- বেদবিৎ পণ্ডিতেরা যাঁকে 'অক্ষর' বলে অভিহিত করেন, বিষয়ে আসক্তিশূন্য সন্ন্যাসীরা যাতে প্রবেশ করেন, ব্রহ্মচারীরা যাঁকে লাভ করার ইচ্ছায় ব্রহ্মচর্য পালন করেন, তাঁর কথা আমি সংক্ষেপে তোমাকে বলব।


শ্লোক:12:

সর্বদ্বারাণি সংযম্য মনো হৃদি নিরুধ্য চ ।

মূর্ধ্ন্যাধায়াত্মনঃ প্রাণমাস্থিতো যোগধারণাম্ ॥১২॥

শব্দার্থঃ সর্বদ্বারাণি – শরীরের সব কয়টি দ্বার, সংযম্য - সংযত করে, মনঃ—মনকে, হৃদি - হৃদয়ে; নিরুধ্য—নিরোধ করে, চ–ও; মূর্ধ্নি - ভ্রুদ্বয়ের মধ্য; আধায়—স্থাপন করে, আত্মনঃ—আত্মার; প্রাণম্—প্রাণবায়ুকে, আস্থিতঃ—স্থিত, যোগধারণাম - যোগধারণা।

অনুবাদ:- ইন্দ্রিয়ের সব কয়টি দ্বার সংযত করে, মনকে হৃদয়ে নিরোধ করে এবং ভ্রুদ্বয়ের মধ্যে প্রাণ স্থাপন করে যোগে স্থিত হতে হয়।


শ্লোক:13:

ওঁ ইত্যেকাক্ষরং ব্রহ্ম ব্যাহরন্মামনুস্মরন্ ।

যঃ প্রয়াতি ত্যজন্ দেহং স যাতি পরমাং গতিম্ ॥১৩॥

শব্দার্থঃ ওঁ—ওঙ্কার; ইতি—এই; একাক্ষরম্ – এক অক্ষর; ব্রহ্ম—ব্রহ্ম; ব্যাহরন্ - উচ্চারণ করতে করতে; মাম্ - আমাকে (কৃষ্ণকে); অনুস্মরন্ - স্মরণ করে, যঃ- যিনি, - প্রয়াতি—প্রয়াণ করেন, তাজন - ত্যাগ করে; দেহম্ — দেহ: সঃ—তিনি, যাতি - প্রাপ্ত হন; পরমাম্—পরম; গতিম্ — গতি।

অনুবাদ:- যোগাভ্যাসে প্রবৃত্ত হয়ে পবিত্র ওঙ্কার(ওঁ) উচ্চারণ করতে করতে কেউ যদি পরমেশ্বর ভগবানকে স্মরণ করে দেহত্যাগ করেন, তিনি অবশ্যই পরমা গতি লাভ করবেন।


শ্লোক:14:

অনন্যচেতাঃ সততং যো মাং স্মরতি নিত্যশঃ ।

তস্যাহং সুলভঃ পার্থ নিত্যযুক্তস্য যোগিনঃ ॥১৪॥

শব্দার্থঃ অনন্যচেতাঃ–একাগ্রচিত্তে; সততম্-নিরন্তর, যঃ- যিনি, মাম্ - আমাকে (শ্রীকৃষ্ণকে), স্মরতি - স্মরণ করেন; নিত্যশঃ - নিয়মিতভাবে। তস্য—তাঁর কাছে, অহম্—আমি; সুলভঃ—সুখলভ‍্য; পার্থ—হে পৃথাপুত্র, নিত্য — নিত্য; যুক্তস‍্য — যুক্ত; যোগিনঃ - ভক্তযোগীর পক্ষে।

অনুবাদ:-হে পার্থ ! যিনি একাগ্রচিত্তে কেবল আমাকেই নিরন্তর স্মরণ করেন, আমি সেই নিত্যযুক্ত ভক্তযোগীর কাছে সুলভ হই।




শ্লোক:15:

মামুপেত্য পুনর্জন্ম দুঃখালয়মশাশ্বতম্ ।

নাপ্নুবন্তি মহাত্মানঃ সংসিদ্ধিং পরমাং গতাঃ ॥১৫॥

শব্দার্থঃ মাম্—আমাকে; উপেত্য - লাভ করে; পুনঃ—পুনরায়; জন্ম–জন্ম; দুঃখালয়ম্ - দুঃখালয়; অশাশ্বতম্ — অনিত্য; ন - না; আপ্নুবন্তি - প্রাপ্ত হন; মহাত্মানঃ—মহাত্মাগণ, সংসিদ্ধিম্ — সিদ্ধি: পরমাম্ — পরম, গতাঃ — প্রাপ্ত হয়েছেন।

অনুবাদ:- মহাত্মা, ভক্তিপরায়ণ যোগীগণ আমাকে লাভ করে আর এই দুঃখপূর্ণ নশ্বর সংসারে পুনরায় জন্মগ্রহণ করেন না, কেন না তাঁরা পরম সিদ্ধি প্র্রাপ্ত হয়েছেন।


শ্লোক:16:

আব্রহ্মভুবনাল্লোকাঃ পুনরাবর্তিনোহর্জুন ।

মামুপেত্য তু কৌন্তেয় পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে॥১৬॥

শব্দার্থঃ আব্রহ্ম—ব্রহ্মলোক পর্যন্ত; ভুবনাৎ— পৃথিবী থেকে; লোকাঃ-লোকসমূহ; পুনঃ– পুনরায়; আবর্তিনঃ—আবর্তনশীল; অর্জুন—হে অর্জুন, মাম্—আমাকে; উপেত্য—প্রাপ্ত হলে; তু–কিন্তু, কৌন্তেয়—হে কুন্তীপুত্র; পুনর্জন্ম— পুনর্জন্ম, ন - না; বিদ্যতে— হয়।

অনুবাদ:- হে অর্জুন ! এই ভুবন থেকে ব্রহ্মলোক পর্যন্ত সমস্ত লোকই পুনরাবর্তনশীল অর্থাৎ পুনর্জন্ম হয়৷ কিন্তু হে কৌন্তেয়! আমাকে প্রাপ্ত হলে আর পুনর্জন্ম হয় না।


শ্লোক:17:

সহস্রযুগপর্যন্তমহর্যদ্ ব্রহ্মণো বিদুঃ ।

রাত্রিং যুগসহস্রান্তাং তেহহোরাত্রবিদো জনাঃ ॥১৭॥

শব্দার্থঃ সহস্র - সহস্র; যুগ - চতুর্যুগ; পর্যন্তম্— ব‍্যাপীঃ অহঃ—দিন; যৎ— যা, ব্রহ্মণঃ - ব্রহ্মার, বিদুঃ—যাঁরা জানেন; রাত্রিম্ — রাত্রি, যুগ—চতুর্যুগ, সহস্ৰান্তাম্—তেমনই, সহস্র চতুর্মুগের অন্তে, তে– সেই, অহোরাত্র - দিন ও রাত্রির, বিদঃ - তত্ত্ববেত্তা, জনাঃ - মানুষেরা।

অনুবাদ:- মনুষ্য মানের সহস্র চতুর্যুগে ব্রহ্মার একদিন হয় এবং সহস্র চতুর্যুগে তাঁর এক রাত্রি হয়। এভাবেই যাঁরা জানেন, তাঁরা দিবা-রাত্রির তত্ত্ববেত্তা৷


শ্লোক:18:

অব্যক্তাদ্ ব্যক্তয়ঃ সর্বাঃ প্রভবন্ত্যহরাগমে ।

রাত্র্যাগমে প্রলীয়ন্তে তত্রৈবাব্যক্তসংজ্ঞকে ॥১৮॥

শব্দার্থঃ অব্যক্তাৎ — অব্যক্ত থেকে, ব্যক্তয়ঃ —জীবসমূহঃ, সর্বাঃ — সমস্ত; প্রভবন্তি — প্রকাশিত হয়; অহরাগমে — দিনের শুরুতে; রাত্র‍্যাগমে - রাত্রি সমাগমে; প্রলীয়ন্তে — লীন হয়ে যায়; তত্র -- সেখানে; এব — অবশ্যই; অব্যক্ত - অব্যক্ত, সংজ্ঞকে - নামক।

অনুবাদ:- ব্রহ্মার দিনের সমাগমে সমস্ত জীব অব্যক্ত থেকে অভিব্যক্ত হয় এবং ব্রহ্মার রাত্রির আগমে তা পুনরায় অব্যক্তে লয় প্রাপ্ত হয়।


শ্লোক:19:

ভূতগ্রামঃ স এবায়ং ভূত্বা ভূত্বা প্রলীয়তে ।

রাত্র্যাগমেহবশঃ পার্থ প্রভবত্যহরাগমে ॥১৯॥

শব্দার্থঃ ভূতগ্রামঃ — জীবসমষ্টি; সঃ– সেই; এব —অবশ্যই; অয়ম্—এই, ভূত্বা ভূত্বা — পুনঃ পুনঃ জন্মগ্রহণ করে; প্রণীয়তে–লয় প্রাপ্ত হয়। রাত্রি - রাত্রি; আগমে—সমাগমে, অবশঃ—আপনা থেকেই; পার্থ—হে পৃথাপুত্র; প্রভবতি – প্রকাশিত হয়; অহঃ - দিনের বেলা; আগমে—আগমনে।

অনুবাদ:- হে পার্থ ! সেই ভূতসমূহ পুনঃ পুনঃ উৎপন্ন হয়ে ব্রহ্মার রাত্রি সমাগমে লয় প্রাপ্ত হয় এবং পুনরায় দিনের আগমনে তারা আপনা থেকেই প্রকাশিত হয়৷


শ্লোক:20:

পরস্তস্মাত্তু ভাবোহন্যোহব্যক্তোহব্যক্তাৎ সনাতনঃ ।

যঃ স সর্বেষু ভূতেষু নশ্যৎসু ন বিনশ্যতি ॥২০॥

শব্দার্থঃ পবঃ — শ্রেষ্ঠ, তস্মাৎ—সেই, তু – কিন্তু, ভাবঃ — প্রকৃতি, অন‍্যঃ – অন্য, অব্যক্তঃ—অব্যক্ত; অব্যক্তাৎ - অব‍্যক্ত থেকে; সনাতনঃ— নিত্য; যঃ—যা, সঃ - তা; সর্বেষু—সমস্ত; ভূতেষু — প্রকাশ, নশ‍্যৎসু – বিনষ্ট হলেও; ন–না; বিনশ্যতি - বিনষ্ট হয়।

অনুবাদ:-কিন্তু আর একটি অব্যক্ত প্রকৃতি রয়েছে, যা নিত্য এবং ব্যক্ত ও অব্যক্ত বস্তুর অতীত। সমস্ত ভূত বিনষ্ট হলেও তা বিনষ্ট হয় না।


শ্লোক:21:

অব্যক্তোহক্ষর ইত্যুক্তস্তমাহুঃ পরমাং গতিম্ ।

যং প্রাপ্য ন নিবর্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম ॥২১॥

শব্দার্থঃ অব্যক্তঃ - অব্যক্ত, অক্ষরঃ—অক্ষর; ইতি—এভাবে, উক্তঃ - বলা হয়, তম্ — তাকে; আহুঃ—বলে; পরমাম্ - পরম; গতিম্ — গতি; যম্ — যাঁকে: প্রাপ্য — পেয়ে; ন— না। নিবর্তন্তে - ফিরে আসে; তদ্ধাম—সেই ধাম: পরমম্ - পরম, মম - আমার।

অনুবাদ:- সেই অব্যক্তকে অক্ষর বলে, তাই সমস্ত জীবের পরমা গতি। কেউ যখন সেখানে যায়, তখন আর তাঁকে এই জগতে ফিরে আসতে হয় না। সেটিই হচ্ছে আমার পরম ধাম।


শ্লোক:22:

পুরুষঃ স পরঃ পার্থ ভক্ত্যা লভ্যস্ত্বনন্যয়া ।

যস্যান্তঃস্থানি ভূতানি যেন সর্বমিদং ততম্ ॥২২॥

শব্দার্থঃ পুরুষঃ- পরমেশ্বর ভগবান, সঃ—তিনি, পরঃ - পরম, যাঁর থেকে শ্রেষ্ঠ আর কেউ নেই; পার্থ – হে পৃথাপুত্র; ভক্ত্যা – ভগবদ্ভক্তির দ্বারা; লভ্যঃ—নাভ করা যায়; তু - কিন্তু অনন্যয়া-অনন্যা, যস‍্য — যাঁর; অন্তঃস্থানি— মধ্যে, ভূতানি—এই সমস্ত জড় প্রকাশ, যেন—যাঁর দ্বারা; সর্বম্ — সমস্ত, ইদম্— এই, ততম্ — পরিবাপ্ত।

অনুবাদ:- হে পার্থ ! সর্বশ্রেষ্ঠ পরমেশ্বর ভগবানকে অনন্যা ভক্তির মাধ্যমেই কেবল লাভ করা যায়। তিনি যদিও তাঁর ধামে নিত্য বিরাজমান, তবুও সর্বব্যাপ্ত এবং সব কিছু তাঁর মধ্যেই অবস্থিত।


শ্লোক:23:

যত্র কালে ত্বনাবৃত্তিমাবৃত্তিং চৈব যোগিনঃ ।

প্রয়াতা যান্তি তং কালং বক্ষ্যামি ভরতর্ষভ ॥২৩॥

শব্দার্থঃ যত্ৰ — যে, কালে - সময়ে, তু–কিন্তু, অনাবৃত্তিম্ — ফিরে আসে না, আবৃত্তিম্ ফিরে আসে; চ–ও, এব — অবশ্যই, যোগিনঃ—বিভিন্ন প্রকার যোগী; প্রয়াতাঃ—মৃত্যু হলে, যান্তি—প্রাপ্ত হন; তম্ — সেই; কালম্ - কাল; বক্ষ্যামি— বলব, ভরতর্ষভ – হে ভারতশ্রেষ্ঠ।

অনুবাদ:- হে ভারতশ্রেষ্ঠ ! যে কালে মৃত্যু হলে যোগীরা এই জগতে ফিরে আসেন অথবা ফিরে আসেন না, সেই কালের কথা আমি তোমাকে বলব।


শ্লোক:24:

অগ্নির্জ্যোতিরহঃ শুক্লঃ ষণ্মাসা উত্তরায়ণম্ ।

তত্র প্রয়াতা গচ্ছন্তি ব্রহ্ম ব্রহ্মবিদো জনাঃ ॥২৪॥

শব্দার্থঃ অগ্নিঃ-অগ্নি; জ্যোতিঃ— জ্যোতি; অহঃ — দিন, শুক্লঃ - শুক্লপক্ষ; যণ্মাসাঃ—ছয় মাস; উত্তরায়ণম্ – উত্তরায়ণ, তত্র — সেই মার্গে: প্রয়াতাঃ- দেহ ত্যাগকারী: গচ্ছন্তি - গমন করেন, ব্রহ্ম—ব্রহ্মে, ব্রহ্মবিদঃ — ব্রহ্মজ্ঞানী; জনাঃ — ব্যক্তি।

অনুবাদ:- ব্রহ্মবিৎ পুরুষগণ অগ্নি, জ্যোতি, শুভদিন, শুক্লপক্ষে ও ছয় মাস উত্তরায়ণ কালে দেহত্যাগ করলে ব্রহ্ম লাভ করেন।


শ্লোক:25:

ধূমো রাত্রিস্তথা কৃষ্ণঃ ষন্মাসা দক্ষিণায়নম্ ।

তত্র চান্দ্রমসং জ্যোতির্যোগী প্রাপ্য নিবর্ততে ॥২৫॥

শব্দার্থঃ ধূমঃ—ধূম; রাত্রিঃ—রাত্রি, তথা — ও, কৃষ্ণঃ– কৃষ্ণপক্ষ; ষন্মাসাঃ — ছয় মাস, দক্ষিণায়নম্ - দক্ষিণায়ন, তত্র—সেই মার্গে, চান্দ্রমসম্ - চন্দ্রলোক, জ্যোতিঃ - জ্যোতি, যোগী - যোগী; প্রাপ‍্য — লাভ করে; নিবর্ততে - প্রত্যাবর্তন করেন।

অনুবাদ:- ধুম, রাত্রি, কৃষ্ণপক্ষ অথবা দক্ষিণায়নের ছয় মাস কালে দেহত্যাগ করে যোগী চন্দ্রলোকে গমনপূর্বক সুখভোগ করার পর পুনরায় মর্ত্যলোকে প্রত্যাবর্তন করেন।


শ্লোক:26:

শুক্লকৃষ্ণে গতী হ্যেতে জগতঃ শাশ্বতে মতে ।

একয়া যাত্যনাবৃত্তিমন্যয়াবর্ততে পুনঃ ॥২৬॥

শব্দার্থঃ শুক্ল - শুক্ল, কৃষ্ণে - কৃষ্ণ, গতী — মার্গ, হি–অবশ্যই, এতে–এই দুই, জগতঃ - ভগতের; শাশ্বতে —বৈদিক; মতে—মতে, একয়া—একটির দ্বারা; যাতি—প্রাপ্ত হয়; অনাবৃত্তিম্ — অপ্রত্যাবর্তন; অন্যয়া—অন্যটির দ্বারা; আবর্ততে প্রত্যাবর্তন করে, পুনঃ—পুনরায়।

অনুবাদ:- বৈদিক মতে এই জগৎ থেকে দেহ ত্যাগের দুইটি মার্গ রয়েছে- একটি শুক্ল এবং অপরটি কৃষ্ণ। শুক্লমার্গে দেহত্যাগ করলে তাকে আর ফিরে আসতে হয় না, কিন্তু কৃষ্ণমার্গে দেহত্যাগ করলে ফিরে আসতে হয়।


শ্লোক:27:

নৈতে সৃতী পার্থ জানন্ যোগী মুহ্যতী কশ্চন ।

তস্মাৎ সর্বেষু কালেষু যোগযুক্তো ভবার্জুন ॥২৭॥

শব্দার্থঃ ন - না, এতে—এই দুটি; সৃতী—মার্গ, পার্থ-হে পৃথাপুত্র; জানন্ – জেনে; যোগী— ভগবদ্ভক্ত, মুহ‍্যতী — মোহগ্রস্ত, কশ্চন - কোন; তস্মাৎ - অতএব; সর্বেষু কালেষু—সর্বদা, যোগযুক্ত - কৃষ্ণভাবনায় যুক্ত, ভৰ–হও, অর্জুন–হে অর্জুন।

অনুবাদ:- হে পার্থ ! ভক্তেরা এই দুইটি মার্গ সম্বন্ধে অবগত হয়ে কখনও মোহগ্রস্ত হন না ৷ অতএব হে অর্জুন ! তুমি ভক্তিযোগ অবলম্বন কর।


শ্লোক:28:

বেদেষু যজ্ঞেষু তপঃসু চৈব দানেষু যৎ পুণ্যফলং প্রদিষ্টম্ ।

অত্যেতি তৎ সর্বমিদং বিদিত্বা যোগী পরং স্থানমুপৈতি চাদ্যম্ ॥২৮॥

শব্দার্থঃ বেদেষু – বেদপাঠে; যজ্ঞেষু— যজ্ঞানুষ্ঠানে তপঃসু – তপস্যায়; চ–ও; এব— অবশ্যই: দানেষু—দানে; যৎ— যে, পুণ্যফলম্ – পুণ্যফল, প্রদিষ্টম্ - নির্দেশিত হয়েছে, অত‍্যোতি — অতিক্রম করে, তৎ সর্বম–সেই সমস্ত; ইদম্—এই, বিদিত্ব — জেনে; যোগী-ভক্ত; পরম্ - পরম; স্থানম্ – স্থান, উপৈতি — প্রাপ্ত হন; চ– ও, আদ্যম— আদি।

অনুবাদ:-ভক্তিযোগ অবলম্বন করলে তুমি কোন ফলেই বঞ্চিত হবে না। বেদপাঠ, যজ্ঞ অনুষ্ঠান, তপস্যা, দান আদি যত প্রকার জ্ঞান ও কর্ম আছে, সেই সমুদয়ের যে ফল, তা তুমি ভক্তিযোগ দ্বারা লাভ করে আদি ও পরম ধাম প্রাপ্ত হও।


ওঁ তৎসদিতি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসূপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জুনসংবাদে 'অক্ষরব্রহ্মযোগো' নামক অষ্টমোঽধ্যায়ঃ সমাপ্তম্।

💐💐💐💐💐

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.