সপ্তম অধ্যায় - জ্ঞান-বিজ্ঞান যোগ
ওঁ তৎ সৎ
শ্রীমদ্ভগবদ গীতা
ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়ঃ
সপ্তম অধ্যায় - জ্ঞান-বিজ্ঞান যোগ
শ্লোক:1:
শ্রীভগবানুবাচঃ
ময্যাসক্তমনাঃ পার্থ যোগং যুঞ্জন্মদাশ্রয়ঃ ।
অসংশয়ং সমগ্রং মাং যথা জ্ঞাস্যসি তচ্ছৃণু ॥১॥
শব্দার্থঃ শ্রীভগবান উবাচ—পরমেশ্বর ভগবান বললেন, ম- আমাতে, আসক্তমনা - অভিনিবিষ্ট চিত্ত, পার্থ–হে পৃথার পুত্র, যোগম্ – যোগ, যুঞ্জ – যুক্ত হয়ে, মদাশ্রয়ঃ—আমার ভাবনায় ভাবিত হয়ে (কৃষ্ণভাবনা), অসংশয়ম্ – নিঃসন্দেহে সমগ্রম্ সম্পূর্ণরূপে, মাম্— আমাকে, যথা— যেরূপে জ্ঞাস্যসি— জানবে, তৎ - তা, শৃণু―শ্রবণ কর।
অনুবাদ:- শ্রীভগবান বললেন- হে পার্থ! আমাতে আসক্তচিত্ত হয়ে, আমাতে মনোনিবেশ করে যোগাভ্যাস করলে, কিভাবে সমস্ত সংশয় থেকে মুক্ত হয়ে আমাকে জানতে পারবে, তা শ্রবণ কর।
শ্লোক:2:
জ্ঞানং তেহহং সবিজ্ঞানমিদং বক্ষ্যাম্যশেষতঃ।
যজ্ জ্ঞাত্বা নেহ ভূয়োহন্যজ্ জ্ঞাতব্যমবশিষ্যতে ॥২॥
শব্দার্থঃ জ্ঞানম্—জ্ঞানের কথা; তে— তোমাকে; অহম্ — আমি; স- বিজ্ঞানম্ – বিজ্ঞান সমন্বিত; ইঁদম্—এই; বক্ষ্যামি - বলব, অশেষতঃ – পূর্ণরূপে; যৎ—যা; জ্ঞাত্বা - জেনে; ন―না; ইহ—এই জগতে; ভূয়ঃ - পুনরায়; অন্যৎ - আর কিছু; জ্ঞাতব্যম্ - জানবার; অবশিষ্যতে—বাকি থাকে।
অনুবাদ:- আমি এখন তোমাকে বিজ্ঞান সমন্বিত এই জ্ঞানের কথা সম্পূর্ণরূপে বলব, যা জানা হলে এই জগতে আর কিছুই জানবার বাকি থাকে না।
শ্লোক:3:
মনুষ্যাণাং সহস্রেষু কশ্চিদ্ যততি সিদ্ধয়ে ।
যততামপি সিদ্ধানাং কশ্চিন্মাং বেত্তি তত্ত্বতঃ ॥৩॥
শব্দার্থঃ মনুষ্যাণাম্ - মানুষের মধ্যে, সহস্রেষু - হাজার হাজার, কশ্চিৎ - কোন একজন, যততি - যত্ন করেন, সিদ্ধয়ে - সিদ্ধি লাভের জন্য। যততাম্ - সেই প্রকার যত্নশীল, অপি - বাস্তবিকই, সিদ্ধানাম্ - সিদ্ধদের, কশ্চিৎ - কেউ, মাম্ - আমাকে, বেত্তি - জানতে পারেন, তত্ত্বতঃ - স্বরূপত ॥৩॥
অনুবাদ:- হাজার হাজার মানুষের মধ্যে কদাচিৎ কোন একজন সিদ্ধি লাভের জন্য যত্ন করেন, আর সেই প্রকার যত্নশীল সিদ্ধদের মধ্যে কদাচিৎ একজন আমাকে অর্থাৎ আমার ভগবৎ-স্বরূপকে তত্ত্বত অবগত হন।
শ্লোক:4:
ভূমিরাপোহনলো বায়ুঃ খং মনো বুদ্ধিরেব চ ।
অহঙ্কার ইতীয়ং মে ভিন্না প্রকৃতিরষ্টধা ॥৪॥
শব্দার্থঃ ভূমিঃ - মাটি, আপঃ - জল, অনলঃ - অগ্নি, বায়ুঃ - বায়ু, খম্ - আকাশ, মনঃ - মন, বুদ্ধিঃ - বুদ্ধি, এব - অবশ্যই, চ - এবং। অহঙ্কারঃ - অহংকার, ইতি - এভাবে, ইয়ম্ - এই সমস্ত, মে - আমার, ভিন্না - ভিন্ন, প্রকৃতিঃ - প্রকৃতি, অষ্টধা - অষ্টবিধ॥৪॥
অনুবাদ:- ভূমি, জল, বায়ু, অগ্নি, আকাশ, মন, বুদ্ধি ও অহঙ্কার- এই আট প্রকারে আমার ভিন্না জড়া প্রকৃতি বিভক্ত।
শ্লোক:5:
অপরেয়মিতস্ত্বন্যাং প্রকৃতিং বিদ্ধি মে পরাম্ ।
জীবভূতাং মহাবাহো যয়েদং ধার্যতে জগৎ॥৫॥
শব্দার্থঃ অপরা - নিকৃষ্ট, ইয়ম্ - এই, ইতঃ - ইহা ব্যতীত, তু - কিন্তু, অন্যাম্ - আর একটি, প্রকৃতিম্ - প্রকৃতি, বিদ্ধি - অবগত হয়, মে - আমার, পরাম্ - উৎকৃষ্ট। জীবভূতাম্ - জীব স্বরূপা, মহাবাহো - হে মহাবীর, যয়া - যার দ্বারা, ইদম্ - এই, ধার্যতে - ধারণ করে আছে, জগৎ - জড় জগৎ ॥৫॥
অনুবাদ:- হে মহাবাহো ! এই নিকৃষ্টা প্রকৃতি ব্যতীত আমার আর একটি উৎকৃষ্টা প্রকৃতি রয়েছে। সেই প্রকৃতি চৈতন্য-স্বরূপা ও জীবভূতা; সেই শক্তি থেকে সমস্ত জীব নিঃসৃত হয়ে এই জড় জগৎকে ধারণ করে আছে।
শ্লোক:6:
এতদ্ যোনীনি ভূতানি সর্বাণীত্যুপধারয় ।
অহং কৃৎস্নস্য জগতঃ প্রভবঃ প্রলয়স্তথা ॥৬॥
শব্দার্থঃ এতদ্ - এই দুটি প্রকৃতি থেকে, যোনীনি - উৎপন্ন হয়েছে, ভূতানি - জড় ও চেতন সবকিছু, সর্বাণি - সমস্ত, ইতি - এই ভাবে, উপধারয় - জ্ঞাত হও। অহম্ - আমি, কৃৎস্নস্য - সমগ্ৰ, জগতঃ - জগতের, প্রভবঃ - উৎপত্তির কারণ, প্রলয়ঃ - প্রলয়, তথা - এবং ॥৬॥
অনুবাদ:- আমার এই উভয় প্রকৃতি থেকে জড় ও চেতন সব কিছু উৎপন্ন হয়েছে। অতএব নিশ্চিতভাবে জেনে রেখো যে, আমিই সমস্ত জগতের উৎপত্তি ও প্রলয়ের মূল কারণ।
শ্লোক:7:
মত্তঃ পরতরং নান্যৎ কিঞ্চিদস্তি ধনঞ্জয় ।
ময়ি সর্বমিদং প্রোতং সূত্রে মণিগণা ইব ॥৭॥
শব্দার্থঃ মত্তঃ - আমার থেকে, পরতরম্ - শ্রেষ্ঠ, ন - না, অন্যৎ - অন্য, কিঞ্চিৎ - কিছু , অস্তি - আছে, ধনঞ্জয় - হে ধনঞ্জয়। ময়ি - আমাতে, সর্বম্ - সবকিছু, ইদম্ - এই, প্রোতম্ - গাঁথা, সূত্রে - সূত্রে, মণিগণাঃ - মণিসমূহের, ইব - মতন ॥৭॥
অনুবাদ:- হে ধনঞ্জয় ! আমার থেকে শ্রেষ্ঠ আর কেউ নেই। সূত্রে যেমন মণিসমূহ গাঁথা থাকে, তেমনই সমস্ত বিশ্বই আমাতে ওতঃপ্রোতভাবে অবস্থান করে।
শ্লোক:8:
রসোহহমপ্সু কৌন্তেয় প্রভাস্মি শশিসূর্যয়োঃ ।
প্রণবঃ সর্ববেদেষু শব্দঃ খে পৌরুষং নৃষু ॥৮॥
শব্দার্থঃ রসঃ - স্বাদ, অহম্ - আমি, অপ্সু - জলে, কৌন্তেয় - হে কঙন্তীপুত্র, প্রভা - জ্যোতি, অস্মি - আমি হই, শশি-সূর্যয়োঃ - চন্দ্র ও সূর্যের। প্রণবঃ - ওঁকার, সর্ব - সমগ্ৰ, বেদেষু - বেদে, শব্দঃ - শব্দ, খে - আকাশে, পৌরুষম্ - ক্ষমতা, নৃষু - মানুষে॥৮॥
অনুবাদ:- হে কৌন্তেয় ! আমিই জলের রস, চন্দ্র ও সূর্যের প্রভা, সর্ববেদের প্রণব, আকাশের শব্দ এবং মানুষের পৌরুষ।
শ্লোক:9:
পূণ্যো গন্ধঃ পৃথিব্যাং চ তেজশ্চাস্মি বিভাবসৌ।
জীবনং সর্বভূতেষু তপশ্চাস্মি তপস্বিষু ॥৯॥
শব্দার্থঃ পূণ্যঃ - পবিত্র, গন্ধঃ - গন্ধ, পৃথিব্যাম্ - পৃথিবীর, চ - ও, তেজঃ - তেজ, চ - ও, অস্মি - আমি হই, বিভাবসৌ - অগ্নির। জীবনম্ - আয়ু, সর্ব - সমস্ত, ভূতেষু - প্রাণীর, তপঃ - তপশ্চর্যা, চ - ও, অস্মি - আমি হই, তপস্বিষু - তপস্বীদের॥৯॥
অনুবাদ:- আমি পৃথিবীর পবিত্র গন্ধ, অগ্নির তেজ, সর্বভূতের জীবন এবং তপস্বীদের তপ।
শ্লোক:10:
বীজং মাং সর্বভূতানাং বিদ্ধি পার্থ সনাতনম্।
বুদ্ধির্বুদ্ধিমতামস্মি তেজস্তেজস্বিনামহম্ ॥১০॥
শব্দার্থঃ বীজম্ - বীজ, মাম্ - আমাকে, সর্বভূতানাম্ - সর্বভূতে্য, বিদ্ধি - জানবে, পার্থ - হছ পৃথা পুত্র,সনাতনম্ - নিত্য। বুদ্ধিঃ - বুদ্ধি, বুদ্ধিমতাম্ - বুদ্ধিমানদের, অস্মি - আমি হই, তেজঃ - তেজ, তেজস্বিনাম্ - তেজস্বীগণের, অহম্ - আমি ॥১০॥
অনুবাদ:- হে পার্থ, আমাকে সর্বভূতের সনাতন কারণ বলে জানবে। আমি বুদ্ধিমানের বুদ্ধি এবং তেজস্বীদের তেজ।
শ্লোক:11:
বলং বলবতাং চাহং কামরাগবিবর্জিতম্ ।
ধর্মাবিরুদ্ধো ভূতেষু কামোহস্মি ভরতর্ষভ॥১১॥
শব্দার্থঃ বলম্ - বল, বলবতাম্ - বলবানের, চ / এবং, অহম্ - আমি, কাম - কাম, রাগ- আসক্তি, বিবর্জিতম্ - বিহীন। ধর্ম-অবিরুদ্ধঃ - ধর্মের অবিরোধী, ভূতেষু - সমস্ত জীবের মধ্যে, কামঃ - কাম, অস্মি - হই, ভরতর্ষভ - হে ভরতকুলশ্রেষ্ঠ ॥১১॥
অনুবাদ:- হে ভরতর্ষভ ! আমি বলবানের কাম ও রাগ বিবর্জিত বল এবং ধর্মের অবিরোধী কামরূপে অমি প্রাণীগণের মধ্যে বিরাজমান।
শ্লোক:12:
যে চৈব সাত্ত্বিকা ভাবা রাজসাস্তামসাশ্চ যে ।
মত্ত এবেতি তান্ বিদ্ধি ন ত্বহং তেষু তে ময়ি ॥১২॥
শব্দার্থঃ যে - যে সকল, চ - এবং, এব - অবশ্যই, সাত্ত্বিকাঃ - সাত্ত্বিক , ভাবাঃ ভাব সমূহ, রাজসাঃ - রাজসিক, তামসাঃ - তামসিক, চ - ও, যে - যে সমস্ত। মত্তঃ - আমার থেকে, এব - অবশ্যই, ইতি - এভাবে, তান্ - সেগুলি, বিদ্ধি - জানবার চেষ্টা কর, ন - নই, তু - কিন্তু, অহম্ - আমি, তেষু - তাদের মধ্যে, তে - তারা, ময়ি - আমাতে ॥১২॥
অনুবাদ:- সমস্ত সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক ভাবসমূহ আমার থেকেই উৎপন্ন বলে জানবে। আমি সেই সকলের অধীন নই, কিন্তু তারা আমার শক্তির অধীন।
শ্লোক:13:
ত্রিভির্গুণময়ৈর্ভাবৈরেভিঃ সর্বমিদং জগৎ ।
মোহিতং নাভিজানাতি মামেভ্যঃ পরমব্যয়ম্ ॥১৩॥
শব্দার্থঃ ত্রিভিঃ - তিন, গুণময়ৈঃ - গুণের দ্বারা, ভাবৈঃ - ভাবের দ্বারা, এভিঃ - এই, সর্বম্ - সমগ্ৰ, ইদম্ - এই, জগৎ - জগৎ। মোহিতম্ - মোহিত, ন, অভিজানাতি - জানতে পারে না, মাম্ - আমি, এভ্যঃ - , পরম্, অব্যয়ম্ ॥১৩॥
অনুবাদ:-(সত্ত্ব, রজ ও তম) তিনটি গুণের দ্বারা মোহিত হওয়ার ফলে সমগ্র জগৎ এই সমস্ত গুণের অতীত ও অব্যয় আমাকে জানতে পারে না।
শ্লোক:14:
দৈবী হ্যেষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া ।
মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে॥১৪॥
শব্দার্থঃ দৈবী - অলৌকিকী, হি - নিশ্চয়, এষা - এই, গুণময়ী - ত্রিগুণময়ী, মম - আমার, মায়া - শক্তি, দুঃ-অত্যয়া - দূরতিক্রমণীয়া। মাম্ - আমাকে, এব - অবশ্যই, যে - যাঁরা, প্রপদ্যন্তে - শরণাগত হন, মায়াম্ - মায়ার শক্তিকে, এতাম্ - এই, তরন্তি - উত্তীর্ণ হন, তে - তাঁরা॥১৪॥
অনুবাদ:- আমার এই দৈবী মায়া ত্রিগুণাত্মিকা এবং তা দুরতিক্রমণীয়া। কিন্তু যাঁরা আমাতে প্রপত্তি করেন, তাঁরাই এই মায়া উত্তীর্ণ হতে পারেন।
শ্লোক:15:
ন মাং দুষ্কৃতিনো মূঢ়াঃ প্রপদ্যন্তে নরাধমাঃ ।
মায়য়াপহৃতজ্ঞানা আসুরং ভাবমাশ্রিতাঃ॥১৫॥
শব্দার্থঃ ন- না, মাম্ - আমাকে, দুষ্কৃতিনঃ- দুষ্কৃতকারী, মূঢ়াঃ - মূঢ়, প্রপদ্যন্তে - শরণাগত হয়, নর-অধমাঃ - নিকৃষ্ট নরগণ। মায়য়া - মায়ার দ্বারা, অপহৃত-জ্ঞানাঃ - অপহৃত যাদের জ্ঞান, আসুরম্ - আসুরিক, ভাবম্ - স্বভাব, আশ্রিতাঃ - আশ্রয় করে ॥১৫॥
অনুবাদ:- মূঢ়, নরাধম, মায়ার দ্বারা যাদের জ্ঞান অপহৃত হয়েছে এবং যারা আসুরিক ভাবসম্পন্ন, সেই সমস্ত দুষ্কৃতকারীরা কখনও আমার শরণাগত হয় না।
শ্লোক:16:
চতুর্বিধা ভজন্তে মাং জনাঃ সুকৃতিনোহর্জুন ।
আর্তো জিজ্ঞাসুরর্থার্থী জ্ঞানী চ ভরতর্ষভ ॥১৬॥
শব্দার্থঃ চতুর্বিধাঃ - চার প্রকার, ভজন্তে - ভজনা করেন, মাম্ - আমাকে, জনাঃ - ব্যক্তিগণ, সুকৃতিনঃ - পুণ্যকর্ম, অর্জুন - হে অর্জুন। আর্তঃ - আর্ত, জিজ্ঞাসুঃ - অনুসন্ধিৎসু, অর্থ-অর্থী - ভোগ অভিলাষী, জ্ঞানী - তত্ত্বজ্ঞ, চ - ও, ভরত-ঋষভ - হে ভরতশ্রেষ্ঠ॥১৬॥
অনুবাদ:- হে ভরতশ্রেষ্ঠ অর্জুন! আর্ত, অর্থাথী, জিজ্ঞাসু ও জ্ঞানী- এই চার প্রকার পুণ্যকর্মা ব্যক্তিগণ আমার ভজনা করেন।
শ্লোক:17:
তেষাং জ্ঞানী নিত্যযুক্ত একভক্তির্বিশিষ্যতে ।
প্রিয়ো হি জ্ঞানিনোহত্যর্থমহং স চ মম প্রিয়ঃ ॥১৭॥
শব্দার্থঃ তেষাম্ - তাদের মধ্যে, জ্ঞানী - তত্ত্বজ্ঞ, নিত্যযুক্তঃ - সর্বদাই আমাতে একাগ্র চিত্ত, এক - একমাত্র, ভক্তিঃ - ভগবদ্ভক্তিতে, বিশিষ্যতে - শ্রেষ্ঠ। প্রিয়োঃ - প্রিয়, হি - যেহেতু, জ্ঞানিনঃ - জ্ঞানীর, অতি-অর্থম্ - অত্যন্ত, অহম্ - আমি, সঃ - তিনি, চ - ও, মম - আমার, প্রিয়ঃ-প্রিয় ॥১৭॥
অনুবাদ:- এই চার প্রকার ভক্তের মধ্যে নিত্যযুক্ত, আমাতে একনিষ্ঠ তত্ত্বজ্ঞানীই শ্রেষ্ঠ। কেননা আমি তাঁর অত্যন্ত প্রিয় এবং তিনিও আমার অত্যন্ত প্রিয়।
শ্লোক:18:
উদারাঃ সর্ব এবৈতে জ্ঞানী ত্বাত্মৈব মে মতম্।
আস্থিতঃ স হি যুক্তাত্মা মামেবানুত্তমাং গতিম্ ॥১৮॥
শব্দার্থঃ উদারাঃ—উদার; সর্ব—সকলে; এব— অবশ্যই; এতে—এরা; জ্ঞানী– জ্ঞানী; তু– কিন্তু, আত্মা এব—আমার নিজের মতো মে— আমার, মতম্—মত, আস্থিতঃ— অবস্থিত; সঃ—তিনি; হি – যেহেতু, যুক্তাত্মা – ভক্তিযোগে যুক্ত, মাম্— আমাকে; এব—অবশ্যই; অনুত্তমাম্—সর্বোৎকৃষ্ট; গতিম্—গতি ৷৷১৮৷৷
অনুবাদ:- এই সকল ভক্তেরা সকলেই নিঃসন্দেহে মহাত্মা, কিন্তু যে জ্ঞানী আমার তত্ত্বজ্ঞানে অধিষ্ঠিত, আমার মতে তিনি আমার আত্মস্বরূপ৷ আমার অপ্রাকৃত সেবায় যুক্ত হয়ে তিনি সর্বোত্তম গতিস্বরূপ আমাকে লাভ করেন।
শ্লোক:19:
বহূনাং জন্মনামন্তে জ্ঞানবান্মাং প্রপদ্যতে।
বাসুদেবঃ সর্বমিতি স মহাত্মা সুদুর্লভঃ ॥১৯॥
শব্দার্থঃ বহূনাম্ - বহু, জন্মনাম্ - জন্মের, অন্তে - পরে, জ্ঞানবাম্ - তত্ত্বজ্ঞানী, মাম্ - আমাতে, প্রপদ্যতে - প্রপত্তি করেন। বাসুদেবঃ - বাসুদেব, সর্বম্ - সমস্ত, ইতি - এভাবে, সঃ - সেই রূপ, মহাত্মা - মহাত্মা, সুদুর্লভঃ - অত্যন্ত দুর্লভ ॥১৯॥
অনুবাদ:- বহু জন্মের পর তত্ত্বজ্ঞানী ব্যক্তি আমাকে সর্ব কারণের পরম কারণ রূপে জেনে আমার শরণাগত হন৷ সেইরূপ মহাত্মা অত্যন্ত দুর্লভ।
শ্লোক:20:
কামৈস্তৈস্তৈর্হৃতজ্ঞানাঃ প্রপদ্যন্তেহন্যদেবতাঃ ।
তং তং নিয়মমাস্থায় প্রকৃত্যা নিয়তাঃ স্বয়া ॥২০॥
শব্দার্থঃ কামৈঃ - কামনা সমূহের দ্বারা, তৈঃ - সেই, তৈঃ - সেই, হৃত - অপহৃত, জ্ঞানাঃ - জ্ঞান, প্রপদ্যন্তে - প্রপত্তি করে, অন্য-দেবতাঃ - অন্য দেবদেবীদের। তম্ - সেই, তম্ - সেই, নিয়মম্ - নিয়ম, আস্থায় - পালন করে, প্রকৃত্যা - স্বভাবের দ্বারা, নিয়তাঃ - নিয়ন্ত্রিত হয়ে, স্বয়া - স্বীয় ॥২০॥
অনুবাদ:-জড় কামনা-বাসনার দ্বারা যাদের জ্ঞান অপহৃত হয়েছে, তারা অন্য দেব-দেবীর শরণাগত হয় এবং তাদের স্বীয় স্বভাব অনুসারে বিশেষ নিয়ম পালন করে দেবতাদের উপাসনা করে।
শ্লোক:21:
যো যো যাং যাং তনুং ভক্তঃ শ্রদ্ধয়ার্চিতুমিচ্ছতি ।
তস্য তস্যাচলাং শ্রদ্ধাং তামেব বিদধাম্যহম্ ॥২১॥
শব্দার্থঃ যঃ - যে, যঃ - যে, যাম্ - যে, যাম্ - যে, তনুম্ - দেবদেবীর মূর্তি, ভক্তঃ - ভক্ত, শ্রদ্ধয়াঃ - শ্রদ্ধা সহকারে, অর্চিতুম্ - পূজা করতে, ইচ্ছতি - ইচ্ছা করে। তস্য - তার, তস্য - তার, অচলাম্ - অচলা, শ্রদ্ধাম্ - শ্রদ্ধা, তাম্ - তাতে, এব - অবশ্যই, বিদধামি - বিধান করি, অহম্ - আমি ॥২১॥
অনুবাদ:- পরমাত্মারূপে আমি সকলের হৃদয়ে বিরাজ করি। যখনই কেউ দেবতাদের পূজা করতে ইচ্ছা করে, তখনই আমি সেই সেই ভক্তের তাতেই অচলা শ্রদ্ধা বিধান করি।
শ্লোক:22:
স তয়া শ্রদ্ধয়া যুক্তস্তস্যারাধনমীহতে ।
লভতে চ ততঃ কামান্ময়ৈব বিহিতান্ হি তান্ ॥২২॥
শব্দার্থঃ সঃ - তিনি, তয়া - সেই, শ্রদ্ধয়া - শ্রদ্ধা সহকারে, যুক্তঃ - যুক্ত হয়ে, তস্য - তার, আরাধনম্ - আরাধনা, ঈহতে - প্রয়াস করেন। লভতে - লাভ করেন, চ - এবং, ততঃ - তার থেকে, কামান্ - কামনা সমূহ, ময়া - আমার দ্বারা, এব - কেবল, বিহিতান্ - বিহিত, হি - অবশ্যই, তান্ - সেই ॥২২॥
অনুবাদ:- সেই ব্যক্তি শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে সেই দেবতার আরাধনা করেন এবং সেই দেবতার কাছ থেকে আমারই দ্বারা বিহিত কাম্য বস্তু অবশ্যই লাভ করেন।
শ্লোক:23:
অন্তবত্তু ফলং তেষাং তদ্ ভবত্যল্পমেধসাম্ ।
দেবান্ দেবযজো যান্তি মদ্ভক্তা যান্তি মামপি ॥২৩॥
শব্দার্থঃ অন্তবৎ - সীমিত ও অস্থায়ী, তু - কিন্তু, ফলম্ - ফল, তেষাম্ - তাদের, তৎ - সেই, ভবতি - হয়, অল্পমেধসাম্ - অল্পবুদ্ধি ব্যক্তিদের। দেবান্ - দেবতাগণকে, দেবযজঃ - দেবোপাসকগণকে , যান্তি - প্রাপ্ত হন, মদ্-ভক্তাঃ - আমার ভক্তগণ, যান্তি - প্রাপ্ত হন, মাম্ আমাকে, অপি - অবশ্যই ॥২৩॥
অনুবাদ:- অল্পবুদ্ধি ব্যক্তিদের আরাধনা লব্ধ সেই ফল অস্থায়ী। দেবোপাসকগণ দেবলোক প্রাপ্ত হন, কিন্তু আমার ভক্তেরা আমার পরম ধাম প্রাপ্ত হন।
শ্লোক:24:
অব্যক্তং ব্যক্তিমাপন্নং মন্যন্তে মামবুদ্ধয়ঃ ।
পরং ভাবমজানন্তো মমাব্যয়মনুত্তমম্ ॥২৪॥
শব্দার্থঃ অব্যক্তম্ - অব্যক্ত, ব্যক্তিম্ - ব্যক্তিত্ব, আপন্নম্ - প্রাপ্ত, মন্যন্তে - মনে করে, মাম্ - আমাকে, অবুদ্ধয়ঃ - বুদ্ধিহীন ব্যক্তিগণ। পরম্ - পরম, ভাবম্ - ভাব, অজানন্তঃ - না জেনে, মম - আমার, অব্যয়ম্ - অব্যয়, অনুত্তমম্ - সর্বোত্তম॥২৪॥
অনুবাদ:- বুদ্ধিহীন মানুষেরা, যারা আমাকে জানে না, মনে করে যে, আমি পূর্বে অব্যক্ত নির্বিশেষ ছিলাম, এখন ব্যক্তিত্ব পরিগ্রহ করেছি। তাদের অজ্ঞতার ফলে তারা আমার অব্যয় ও সর্বোত্তম পরম ভাব সম্বন্ধে অবগত নয়।
শ্লোক:25:
নাহং প্রকাশঃ সর্বস্য যোগমায়াসমাবৃতঃ ।
মূঢ়োহয়ং নাভিজানাতি লোকো মামজমব্যয়ম্ ॥২৫॥
শব্দার্থঃ ন - না, অহম্ - আমি, প্রকাশঃ - প্রকাশিত, সর্বস্য - সকলের কাছে, যোগমায়া - অন্তরঙ্গা শক্তির দ্বারা, সমাবৃতঃ - আবৃত। মূঢ়ঃ - মূঢ়, অয়ম্ - এই, ন - না, অভিজানাতি - জানতে পারে, লোকঃ - ব্যক্তিরা, মাম্ - আমাকে, অজম্ - জন্মরহিত, অব্যয়ম্ - অব্যয় ॥২৫॥
অনুবাদ:- আমি মূঢ় ও বুদ্ধিহীন ব্যক্তিদের কাছে কখনও প্রকাশিত হই না। তাদের কাছে আমি আমার অন্তরঙ্গা শক্তি যোগমায়ার দ্বারা আবৃত থাকি৷ তাই, তাঁরা আমার অজ ও অব্যয় স্বরূপকে জানতে পারে না।
শ্লোক:26:
বেদাহং সমতীতানি বর্তমানানি চার্জুন ।
ভবিষ্যাণি চ ভূতানি মাং তু বেদ ন কশ্চন ॥২৬॥
শব্দার্থঃ বেদ - জানি, অহম্ - আমি, সম্-অতীতানি - সম্পূর্ণ রূপে অতীত, বর্তমানানি - বর্তমান, চ - এবং, অর্জুন - হে অর্জুন। ভবিষ্যাণি - ভবিষ্যৎ, চ - ও, ভূতানি - জীবসমূহ, মাম্ - আমাকে, তু - কিন্তু, বেদ - জানে, ন - না, কঃ-চন - কেউই ॥২৬॥
অনুবাদ:- হে অর্জুন ! পরমেশ্বর ভগবানরূপে আমি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সম্পূর্ণরূপে অবগত। আমি সমস্ত জীব সম্বন্ধে জানি, কিন্তু আমাকে কেউ জানে না।
শ্লোক:27:
ইচ্ছাদ্বেষসমুত্থেন দ্বন্দ্বমোহেন ভারত ।
সর্বভূতানি সম্মোহং সর্গে যান্তি পরন্তপ ॥২৭॥
শব্দার্থঃ ইচ্ছা- বাসনা, দ্বেষ- দ্বেষ, সমুত্থেন - উদ্ভুত, দ্বন্দ্ব- দ্বন্দ্ব, মোহেন - মোহের দ্বারা, ভারত - হে ভারত। সর্বভূতানি - সমস্ত জীব সমূহ, সম্মোহম্ - মোহাচ্ছন্ন, সর্গে - সৃষ্টির সময়ে, যান্তি - প্রাপ্ত হয়, পরন্তপ - হে শত্রু নিপাতকারী ॥২৭॥
অনুবাদ:- হে ভারত! হে পরন্তপ! ইচ্ছা ও দ্বেষ থেকে উদ্ভূত দ্বন্দ্বের দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে সমস্ত জীব মোহাচ্ছন্ন হয়ে জন্মগ্রহণ করে।
শ্লোক:28:
যেষাং ত্বন্তগতং পাপং জনানাং পুণ্যকর্মণাম্ ।
তে দ্বন্দ্বমোহনির্মুক্তা ভজন্তে মাং দৃঢ়ব্রতাঃ ॥২৮॥
শব্দার্থঃ যেষাম্ - যে সমস্ত, তু - কিন্তু, অন্তগতম্ - সম্পূর্ণ রূপে দূরীভূত, পাপম্ - পাপ, জনানাম্ - ব্যক্তিদের, পুণ্য - পুণ্য, কর্মণাম্ -কর্মকারী । তে - তারা, দ্বন্দ্ব - দ্বন্দ্ব, মোহ- মোহ, নির্মুক্তাঃ - বিমুক্ত, ভজন্তে - ভজনা করে, মাম্ - আমাকে, দৃঢ়ব্রতাঃ - দৃঢ় নিষ্ঠার সঙ্গে ॥২৮॥
অনুবাদ:- যে সমস্ত পুণ্যবান ব্যক্তির পাপ সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত হয়েছে এবং যাঁরা দ্বন্দ্বমোহ থেকে মুক্ত হয়েছেন, তাঁরা দৃঢ় নিষ্ঠার সঙ্গে আমার ভজনা করেন।
শ্লোক:29:
জরামরণমোক্ষায় মামাশ্রিত্য যতন্তি যে ।
তে ব্রহ্ম তদ্ বিদুঃ কৃৎস্নমধ্যাত্মং কর্ম চাখিলম্॥২৯॥
শব্দার্থঃ জরা- বার্ধক্য, মরণ- - মৃই, মোক্ষায় - মুক্তি লাভের জন্য, মাম্ - আমাকে, আশ্রিত্য - আশ্রয় করে, যতন্তি - যত্ন করেন, যে - যাঁরা। তে - তাঁরা, ব্রহ্ম - ব্রহ্ম, তৎ - সেই, বিদুঃ - জানতে পারেন, কৃৎস্নম্ - সব কিছু, অধ্যাত্মম্ - আধ্যাত্মতত্ত্ব, কর্ম - কর্মতত্ত্ব, চ - ও, অখিলম্ - সম্পূর্ণরূপে॥২৯॥
অনুবাদ:- যে সমস্ত বুদ্ধিমান ব্যক্তি জ্বরা ও মৃত্যু থেকে মুক্তি লাভের জন্য আমাকে আশ্রয় করে যত্ন করেন, তাঁরা প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মভূত, কেন না তাঁরা অধ্যাত্মতত্ত্ব ও কর্মতত্ত্ব সব কিছু সম্পূর্ণরূপে অবগত।
শ্লোক:30:
সাধিভূতাধিদৈবং মাং সাধিযজ্ঞং চ যে বিদুঃ ।
প্রায়াণকালেহপি চ মাং তে বিদুর্যুক্তচেতসঃ ॥৩০॥
শব্দার্থঃ স-অধিভূত- অধিভূত, অধিদৈবম্ - অধিদৈব, মাম্ - আমাকে, স-অধিযজ্ঞম্ - অধিযজ্ঞ সহ, চ - এবং, যে - যাঁরা, বিদুঃ - জানেন। প্রায়াণকালে - মৃত্যুর সময়, অপি - এমনকি, চ - এবং, মাম্ - আমাকে, তে - তাঁরা, বিদুঃ - জানেন, যুক্তচেতসঃ - আমাতে আসক্ত চিত্ত ॥৩০॥
অনুবাদ:- যাঁরা অধিভূত-তত্ত্ব, অধিদৈব-তত্ত্ব ও অধিযজ্ঞ-তত্ত্ব সহ আমাকে পরমেশ্বর ভগবান বলে অবগত হন, তাঁরা আমাতে আসক্তচিত্ত, এমন কি মরণকালেও আমাকে জানতে পারেন।
ওঁ তৎসদিতি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসূপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জুনসংবাদে 'জ্ঞানবিজ্ঞানযোগো' নামক সপ্তমোঽধ্যায়ঃ সমাপ্তম্।
Post a Comment