দশম অধ্যায় - বিভূতি যোগ
ওঁ তৎ সৎ
ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়ঃ
শ্রীমদ্ভগবদ গীতা
দশম অধ্যায় - বিভুতি যোগ
শ্লোক:1:
শ্রীভগবান্ উবাচঃ
ভূয় এব মহাবাহো শৃণু মে পরমং বচঃ ।
যত্তেহহং প্রীয়মাণায় বক্ষ্যামি হিতকাম্যয়া॥১॥
শব্দার্থঃ শ্রীভগবান্ উবাচঃ – পরমেশ্বর ভগবান বললেন, ভূয়ঃ— পুনরায়; এব– অবশ্যই; মহাবাহো-হে মহাবীর, শৃণু – শ্রবণ কর; মে — আমার, পরমম্— পরম; বচঃ - বাক্য, যৎ — যা, তে - তোমাকে, অহম্ – আমি; প্রীয়মাণায়—আমার প্রিয় পাত্র বলে মনে করে, বক্ষ্যামি— বলব; হিতকাম্যয়া—হিত কামনায়।
অনুবাদ:-পরমেশ্বর ভগবান বললেন- হে মহাবাহো! পুনরায় শ্রবণ কর৷ যেহেতু তুমি আমার প্রিয় পাত্র, তাই তোমার হিতকামনায় আমি পূর্বে যা বলেছি, তার থেকেও উৎকৃষ্ট তত্ত্ব বলছি।
শ্লোক:2:
ন মে বিদুঃ সুরগণাঃ প্রভবং ন মহর্ষয়ঃ ।
অহমাদির্হি দেবানাং মহর্ষীণাং চ সর্বশঃ ॥২॥
শব্দার্থঃ ন—না; মে—আমার; বিদুঃ– জানেন; সুরগণাঃ— দেবতাগণ, প্রভবম্ – উৎপত্তি; ন—না; মহর্ষয়ঃ—মহর্ষিগণ; অহম্—আমি; আদিঃ— আদি কারণ, হি— অবশ্যই, দেবানাম— দেবতাদের; মহর্ষীণাম- মহর্ষিদের; চ–ও; সর্বশঃ- সর্বতোভাবে।
অনুবাদ:-দেবতারা বা মহর্ষিরাও আমার উৎপত্তি অবগত হতে পারে না, কেন না, সর্বতোভাবে আমিই দেবতা ও মহর্ষিদের আদি কারণ।
শ্লোক:3:
যো মামজমনাদিং চ বেত্তি লোকমহেশ্বরম্ ।
অসংমূঢ়ঃ স মর্ত্যেষু সর্বপাপৈঃ প্রমুচ্যতে ॥৩॥
শব্দার্থঃ যঃ- যিনি, মাম্ – আমাকে, অজম্– জন্মরহিত; অনাদিম্— অনাদি; চ–ও; বেত্তি— জানেন: লোক— সমস্ত গ্রহলোকের: মহেশ্বরম— ঈশ্বর; অসংমূঢ়ঃ - মোহশূন্য হয়ে; সঃ — তিনি, মর্ত্যেষু— মরণশীলদের মধ্যে; সর্বপাপৈঃ — সমস্ত পাপ থেকে, প্রমূচ্যতে – মুক্ত হন।
অনুবাদ:- যিনি আমাকে জন্মরহিত, অনাদি ও সমস্ত গ্রহলোকের মহেশ্বর বলে জানেন, তিনিই কেবল মানুষদের মধ্যে মোহশুন্য হয়ে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হন।
শ্লোক:4:
বুদ্ধির্জ্ঞানমসংমোহঃ ক্ষমা সত্যং দমঃ শমঃ ।
সুখং দুঃখং ভবোহভাবো ভয়ং চাভয়মেব চ ॥৪॥
শব্দার্থঃ বুদ্ধিঃ – বুদ্ধি, জ্ঞানম্ - জ্ঞান, অসংমোহঃ- সংশয়মুক্তি, ক্ষমা - ক্ষমা, সত্যম্ - সত্যবাদিতা, দমঃ— ইন্দ্রিয় সংযম, শমঃ- মন। সুখম্ - সুখ, দুঃখম্ - দুঃখ, ভবঃ– জন্ম, অভাবঃ- মৃত্যু, ভয়ম্ - ভয়, চ –ও, অভয়ম্ – অভয়, এব - ও, চ—এবং।
অনুবাদ:- বুদ্ধি, জ্ঞান, সংশয় ও মোহ থেকে মুক্তি, ক্ষমা, সত্যবাদিতা, ইন্দ্রিয়-সংয্ম, মনসংযম, সুখ, দুঃখ, জন্ম, মৃত্যু, ভয়, অভয়, অহিংসা, সমতা, সন্তোষ, তপস্যা, দান, য্শ ও অয্শ- প্রাণিদের এই সমস্ত নানা প্রকার ভাব আমার থেকেই উৎপন্ন হয়।
শ্লোক:5:
অহিংসা সমতা তুষ্টিস্তপো দানং যশোহযশোঃ ।
ভবন্তি ভাবা ভূতানাং মত্ত এব পৃথগ্ বিধাঃ ॥৫॥
শব্দার্থঃ অহিংসা — অহিংসা সমতা সমতা তুষ্টি: সন্তুষ্টি তপঃ— তপশ্চর্যা, দানস্ – দান; যশঃ– যশ: অযশঃ– অযশ, ভবস্তি উৎপন্ন হয়; ভাবাঃ — ভাগ; ভূতানাম্— প্রাণীদের; মত্তঃ—আমার থেকে, এব– অবশ্যই; পৃথবিধাঃ -নানা প্রকার।
অনুবাদঃ অহিংসা অর্থাৎ নিজ আত্মাকে অধোগতিতে যেতে না দেওয়ার আচরণ, সমতা অর্থাৎ যাঁর মধ্যে বৈষম্যভাব থাকে না, সন্তোষ, তপ অর্থাৎ মন এবং ইন্দ্রিয়সমূহকে লক্ষ্যের অনুরূপ তৈরী করা, দান অর্থাৎ সর্বস্বের সমর্পণ, ভগবৎপথে মান-অপমান সহ্য করা--এইরূপ প্রাণীগণের ভাব আমার থেকেই সম্পাদিত হয়। এইসকল ভাব দৈবী চিন্তন-পদ্ধতির লক্ষণ।
শ্লোক:6:
মহর্ষয়ঃ সপ্ত পূর্বে চত্বারো মনবস্তথা ।
মদ্ ভাবা মানসা জাতা যেসাং লোক ইমাঃ প্রজাঃ ॥৬॥
শব্দার্থঃ মহর্ষয়ঃ – মহর্ষিগণ; সপ্ত— সাত, পূর্বে - পূর্বে; চত্ত্বারঃ – সনকাদি
চারজন, মনবঃ- চতুর্দশ মনু; তথা- ও, মদ্ভাবাঃ- আমার থেকে জন্মগ্রহণ করেছে,
মানসাঃ— মন থেকে; জাতাঃ— উৎপন্ন; যেষাম্— যাঁদের, লোকে - এই জগতে; ইমাঃ — এই
সমস্ত, প্রজাঃ—প্রজাসমূহ।
অনুবাদ:- সপ্ত মহর্ষি, তাঁদের পূর্বজাত সনকাদি চার কুমার ও চতুর্দশ মনু, সকলেই আমার মন থেকে উৎপন্ন হয়ে আমা হতে জন্মগ্রহণ করেছে এবং এই জগতের স্থাবর-জঙ্গম আদি সমস্ত প্রজা তাঁরাই সৃষ্টি করেছেন।
শ্লোক:7:
এতাং বিভূতিং যোগং চ মম যো বেত্তি তত্ত্বতঃ।
সোহবিকল্পেন যোগেন যুজ্যতে নাত্র সংশয়ঃ ॥৭॥
শব্দার্থঃ এতাম্ — এই সমস্ত; বিভূতিম্ – বিভূতি; যোগম্ – যোগ; চ – ও; মম — আমার; যঃ —যিনি, বেত্তি— জানেন; তত্ত্বতঃ — যথার্থরূপে। সঃ- তিনি; অবিকল্পেন— অবিচলিত; যোগেন— ভক্তিযোগ দ্বারা; যুজ্যতে— যুক্ত হন, ন–না; অত্র— এই বিষয়ে, সংশয়ঃ- সন্দেহ।
অনুবাদ:- যিনি আমার এই বিভূতি ও যোগ যথার্থরূপে জানেন, তিনি অবিচলিতভাবে ভক্তিযোগে যুক্ত হন৷ সেই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
শ্লোক:8:
অহং সর্বস্য প্রভবো মত্তঃ সর্বং প্রবর্ততে ।
ইতি মত্বা ভজন্তে মাং বুধা ভাবসমন্বিতাঃ॥৮॥
শব্দার্থঃ অহম্ – আমি; সর্বস্য— সকলের; প্রভবঃ— উৎপত্তির হেতু; মত্তঃ- আমার থেকে; সর্ব—সব কিছু; প্রবর্ততে—প্রবর্তিত হয়; ইতি—এভাবে; মত্বা— জেনে; ভজতে— ভজন করেন, মাম্—আমাকে; বুধাঃ—পণ্ডিতগণ; ভাবসমন্বিতাঃ—ভাবযুক্ত হয়ে।
অনুবাদ:- আমি জড় ও চেতন জগতের সব কিছুর উৎস। সব কিছু আমার থেকেই প্রবর্তিত হয়। সেই তত্ত্ব অবগত হয়ে পণ্ডিতগণ শুদ্ধভক্তি সহকারে আমার ভজনা করেন।
শ্লোক:9:
মচ্চিত্তা মদ্ গতপ্রাণা বোধয়ন্তঃ পরস্পরম্ ।
কথয়ন্তশ্চ মাং নিত্যং তুষ্যন্তি চ রমন্তি চ ॥৯॥
শব্দার্থঃ মচ্চিত্তাঃ—যাদের চিত্ত সম্পূর্ণরূপে আমাতে সমর্পিত; মদ্গতপ্রাণাঃ—তাঁদের প্রাণ আমাতে সমর্পিত; বোধয়ন্তঃ—বুঝিয়ে; পরস্পরম্– পরস্পরকে, কথয়ন্তঃ আলোচনা করে, চ – ও, মাম্ - আমার সম্বন্ধেই; নিত্যম্ — সর্বদা; তুষ্যন্তি—তুষ্ট হন; চ–ও; রমন্তি—অপ্রাকৃত আনন্দ লাভ করেন; চ–ও।
অনুবাদ:- যাঁদের চিত্ত ও প্র্রাণ সম্পূর্ণরূপে আমাতে সমর্পিত, তাঁরা পরস্পরের মধ্যে আমার কথা সর্বদাই আলাচনা করে এবং আমার সম্বন্ধে পরস্পরকে বুঝিয়ে পরম সন্তোষ ও অপ্রাকৃত আনন্দ লাভ করেন।
শ্লোক:10:
তেষাং সততযুক্তানাং ভজতাং প্রীতিপূর্বকম্ ।
দদামি বুদ্ধিযোগং তং যেন মামুপযান্তি তে ॥১০॥
শব্দার্থঃ তেষাম্—তাঁদের; সততযুক্তানাম্ – নিত্যযুক্ত, ভজতাম্― ভক্তিযুক্ত সেবাপরায়ণ হয়ে, প্রীতিপূর্বকম্—প্রীতিপূর্বক; দদামি—দান করি; বুদ্ধিযোগম্ - বুদ্ধিযোগ; তম্—সেই, যেন—যার দ্বারা; মাম্ আমাকে, উপযান্তি—প্রাপ্ত হন; তে—তাঁরা।
অনুবাদ:- যাঁরা ভক্তিযোগ দ্বারা প্রীতিপূর্বক আমার ভজনা করে নিত্যযুক্ত, আমি তাঁদের শুদ্ধ জ্ঞানজনিত বুদ্ধিযোগ দান করি, যার দ্বারা তাঁরা আমার কাছে ফিরে আসতে পারেন।
শ্লোক:11:
তেষামেবানুকম্পার্থমহমজ্ঞানজং তমঃ ।
নাশয়াম্যাত্মভাবস্থো জ্ঞানদীপেন ভাস্বতা ॥১১॥
শব্দার্থঃ তেষাম্—তাঁদের; এব–অবশ্যই; অনুকম্পার্থম্— অনুগ্রহ করার জন্য; অহম্ – আমি; অজ্ঞানজম্—অজ্ঞান-জনিত; তমঃ– অন্ধকার, নাশয়ামি - নাশ করি, আত্মভাবস্থঃ — হৃদয়ে অবস্থিত হয়ে, জ্ঞান–জ্ঞানের, দীপেন—প্রদীপের দ্বারা; ভাস্বতা - উজ্জ্বল।
অনুবাদ:-তাঁদের প্রতি অনুগ্রহ করার জন্য আমি তাঁদের হৃদয়ে অবস্থিত হয়ে, উজ্জ্বল জ্ঞান-প্রদীপের দ্বারা অজ্ঞান-জনিত অন্ধকার নাশ করি।
শ্লোক:12:
অর্জন উবাচঃ
পরং ব্রহ্ম পরং ধাম পবিত্রং পরমং ভবান্ ।
পুরুষং শাশ্বতং দিব্যমাদিদেবমজং বিভুম্ ॥১২॥
শব্দার্থঃ অর্জুনঃ উবাচ–অর্জুন বললেন, পরম্ – পরম, ব্রহ্ম – সত্য; পরম্—পরম; ধাম— ধাম; পবিত্রম্ — পবিত্র; পরমম্—পরম; ভবান্— তুমি; পুরুষম্—পুরুষ; শাশ্বতম্ – সনাতন; দিব্যম—দিব্য: আদিদেবম্— আদিদেব; অজম—জন্মরহিত; বিভূম সর্বশ্রেষ্ঠ।
শ্লোক:13:
আহুস্তামৃষয়ঃ সর্বে দেবর্ষির্নারদস্তথা ।
অসিতো দেবলো ব্যাসঃ স্বয়ং চৈব ব্রবীষি মে ॥১৩॥
শব্দার্থঃ আহুঃ—বলেন; তাম্— তোমাকে; ঋষয়ঃ — ঋষিগণ; সর্বে—সমস্ত, দেবর্ষিঃ—দেবর্ষি; নারদঃ – নারদ, তথা—ও; অসিতঃ — অসিত, দেবলঃ-দেবল, ব্যাসঃ—ব্যাসদেব; স্বয়ম— তুমি নিজে; চ–ও; এব—অবশ্যই ব্রবীষি, মে-আমাকে।
অনুবাদ:- অর্জুন বললেন- তুমি পরম ব্রহ্ম, পরম ধাম, পরম পবিত্র ও পরম পুরুষ৷ তুমি নিত্য, দিব্য, আদি দেব, অজ ও বিভু। দেবর্ষি নারদ, অসিত, দেবল, ব্যাস আদি ঋষিরা তোমাকে সেভাবেই বর্ণনা করেছেন এবং তুমি নিজেও এখন আমাকে তা বলছ।
শ্লোক:14:
সর্বমেতদ্ ঋতং মন্যে যন্মাং বদসি কেশব ।
ন হি তে ভগবন্ ব্যক্তিং বিদুর্দেবা ন দানবাঃ ॥১৪॥
শব্দার্থঃ সর্বম্ — সমস্ত; এতৎ—এই; ঋতম্ – সত্য; মন্যে—মনে করি; যৎ- যা, মাম্ - আমাকে, বদসি - বলেছ, কেশব – হে কৃষ্ণ, ন–না, হি–অবশ্যই, তে–তোমার; ভগবন্— হে পরমেশ্বর ভগবান; ব্যক্তিম্—তত্ত্ব; বিদুঃ—জানতে পারে, দেবাঃ - দেবতারা; ন–না; দানবাঃ-দানবেরা।
অনুবাদ:-হে কেশব ! তুমি আমাকে যা বলেছ, তা আমি সত্য বলে মনে করি৷ হে ভগবান ! দেবতা অথবা দানবেরা কেউই তোমার তত্ত্ব য্থাযথভাবে অবগত নন।
শ্লোক:15:
স্বয়মেবাত্মনাত্মানং বেত্থ ত্বং পুরুষোত্তম ।
ভূতভাবন ভূতেশ দেবদেব জগৎপতে ॥১৫॥
শব্দার্থঃ স্বয়ম্ – স্বয়ং; এব—অবশ্যই: আত্মনা—নিজেই; আত্মানম্ — নিজেকে; বেত্থ—জান; ত্বম্ — তুমি; পুরুষোত্তম — হে পুরুষোত্তম; ভূতভাবন—হে সর্বভূতের উৎস; ভূতেশ—হে সর্বভূতের ঈশ্বর, দেবদেব—দেবতাদেরও দেবতা; জগৎপতে – হে বিশ্বপালক।
অনুবাদ:- হে পুরুষোত্তম ! হে ভূতভাবন ! হে ভূতেশ! হে দেবদেব! হে জগৎপতে! তুমি নিজেই তোমার চিৎশক্তির দ্বারা তোমার ব্যক্তিত্ত্ব অবগত আছ।
শ্লোক:16:
বক্তুমর্হস্যশেষেণ দিব্যা হ্যাত্মবিভূতয়ঃ ।
যাভির্বিভূতিভির্লোকানিমাংস্ত্বং ব্যাপ্য তিষ্ঠসি ॥১৬॥
শব্দার্থঃ বক্তুম্-বলতে; অর্হসি—সক্ষম; অশেষেণ—বিস্তারিতভাবে; দিব্যাঃ—দিব্য; হি - অবশ্যই; আত্ম—স্বীয়; বিভূতয়ঃ—বিভূতিসকল যাভিঃ- যে সমস্ত, বিভৃতিভিঃ— বিভূতি দ্বারা; লোকান্—লোকসমূহ; ইমান্—এই সমস্ত; ত্বম্ — তুমি; ব্যাপ্য—ব্যাপ্ত হয়ে; তিষ্ঠসি— অবস্থান করছ।
অনুবাদ:- তুমি যে বিভূতির দ্বারা এই লোক সমূহে পরিব্যাপ্ত হয়ে আছ, সেই সমস্ত তোমার দিব্য বিভূতি সকল তুমিই কেবল বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করতে সমর্থ।
শ্লোক:17:
কথং বিদ্যামহং যোগিংস্ত্বাং সদা পরিচিন্তয়্ন্ ।
কেষু কেষু চ ভাবেষু চিন্ত্যোহসি ভগবন্ময়া॥১৭॥
শব্দার্থঃ কথম্—কিভাবে; বিদ্যাম্ অহম্ — আমি জানব; যোগিন্—হে যোগেশ্বর; ত্বাম্ তোমাকে; সদা—সর্বদা, পরিচিন্তয়ন্—চিন্তা করে, কেষু–কোন্; কেষু–কোন, চ - ও, ভাবেষু - ভাবে, চিন্ত্যঃ অসি–চিন্তনীয় হও, ভগবন্ — হে পরমেশ্বর ভগবান, ময়া - আমার দ্বারা।
অনুবাদ:- হে যোগেশ্বর ! কিভাবে সর্বদা তোমার চিন্তা করলে আমি তোমাকে জানতে পারব? হে ভগবান! কোন্ কোন্ বিবিধ আকৃতির মাধ্যমে আমি তোমাকে চিন্তা করব?
শ্লোক:18:
বিস্তরেণাত্মনো যোগং বিভূতিং চ জনার্দন ।
ভূয়ঃ কথয় তৃপ্তির্হি শৃণ্বতো নাস্তি মেহমৃতম্ ॥১৮॥
শব্দার্থঃ বিস্তরেণ—বিস্তারিতভাবে; আত্মনঃ—তোমার, যোগম্—যোগ, বিভূতিম্ – বিভূতি চ–ও; জনার্দন–হে জনার্দন। ভূয়ঃ— পুনরায়, কথয়—বল; তৃপ্তিঃ—তৃপ্তি; হি - অবশ্যই; শৃণ্বতঃ—শ্রবণ করে; ন অস্তি— হচ্ছে না; মে–আমার; অমৃতম্ – উপদেশামৃত।
অনুবাদ:- হে জনার্দন ! তোমার যোগ ও বিভূতি বিস্তারিতভাবে পুনরায় আমাকে বল৷ কারণ তোমার উপদেশামৃত পান করে আমার পরিতৃপ্তি হচ্ছে না; আমি আরও শ্রবণ করতে ইচ্ছা করি।
শ্লোক:19:
শ্রীভগবানুবাচঃ
হন্ত তে কথয়িষ্যামি দিব্যা হ্যাত্মবিভূতয়ঃ ।
প্রাধান্যতঃ কুরুশ্রেষ্ঠ নাস্ত্যন্তো বিস্তরস্য মে ॥১৯॥
শব্দার্থঃ শ্রীভগবান্ উবাচ – পরমেশ্বর ভগবান বললেন, হন্ত - হ্যাঁ, তে–তোমাকে; কথয়িষ্যামি—আমি বলব; দিব্যাঃ—দিব্য, হি–অবশ্যই, আত্মবিভূতয়ঃ—আমার বিভূতিসমূহ; প্রাধান্যতঃ—যেগুলি প্রধান; কুরুশ্রেষ্ঠ— হে কুরুশ্রেষ্ঠ; নাস্তি-নেই; অন্তঃ–অন্ত, বিত্তরসা —বিভূতি বিস্তারের; মে—আমার।
অনুবাদ:- পরমেশ্বর ভগবান বললেন- হে অর্জুন, আমার দিব্য প্রধান প্রধান বিভূতিসমূহ তোমাকে বলব, কিন্তু আমার বিভূতিসমূহের অন্ত নেই।
শ্লোক:20:
অহমাত্মা গুড়াকেশ সর্বভূতাশয়স্থিতঃ ।
অহমাদিশ্চ মধ্যং চ ভূতানামন্ত এব চ ॥২০॥
শব্দার্থঃ অহম্ – আমি; আত্মা— আত্মা: গুড়াকেশ–হে অর্জুন: সর্বভূত— সমস্ত জীবের, আশয়স্থিতঃ— হৃদয়ে অবস্থিত; অহম্— আমি; আদিঃ—আদি; চ–ও, মধ্যম – মধ্য; চ–ও, ভূতানাম্ – সমস্ত জীবের অন্তঃ– অন্ত; এব– অবশ্যই; চ–এবং।
অনুবাদ:- হে গুড়াকেশ ! আমিই সমস্ত জীবের হৃদয়ে অবস্থিত পরমাত্মা, আমিই সর্বভূতের আদি, মধ্য ও অন্ত।
শ্লোক:21:
আদিত্যানামহং বিষ্ণুর্জ্যোতিষাং রবিংশুমান্ ।
মরীচির্মরুতামস্মি নক্ষত্রাণামহং শশী ॥২১॥
শব্দার্থঃ আদিত্যানাম্—আদিত্যদের মধ্যে; অহম্—আমি, বিষ্ণুঃ– বিষ্ণু, জ্যোতিষাম— জ্যোতিষ্কদের মধ্যে; রবিঃ- সূর্য; অংশুমান্ - কিরণশালী; মরীচিঃ-মরীচি, মরুতাম্— মরুতদের মধ্যে; অস্মি—হই; নক্ষত্রাণাম্ - নক্ষত্রদের মধ্যে; অহম্ - আমি; শশী—চন্দ্ৰ।
অনুবাদ:- আদিত্যদের মধ্যে আমি বিষ্ণু, জ্যোতিষ্কদের মধ্যে আমি কিরণশালী সূর্য, মরুতদের মধ্যে আমি মরীচি এবং নক্ষত্রদের মধ্যে আমি চন্দ্র।
শ্লোক:22:
বেদানাং সামবেদোহস্মি দেবানামস্মি বাসবঃ।
ইন্দ্রিয়াণাং মনশ্চাস্মি ভূতানামস্মি চেতনা ॥২২॥
শব্দার্থঃ বেদানাম্—সমস্ত বেদের মধ্যে; সামবেদঃ—সামবেদ; অস্মি—হই; দেবানাম্—সমস্ত দেবতাদের মধ্যে; অস্মি—হই; বাসবঃ—ইন্দ্ৰ; ইন্দ্ৰিয়াণাম্—সমস্ত ইন্দ্রিয়ের মধ্যে; মনঃ—মন; চ–ও; অস্মি—হই; ভূতানাম্—প্রাণীদের মধ্যে; অস্মি—হই; চেতনা— চেতনা।
অনুবাদ:- সমস্ত বেদের মধ্যে আমি সামবেদ, সমস্ত দেবতাদের মধ্যে আমি ইন্দ্র, সমস্ত ইন্দ্রিয়ের মধ্যে আমি মন এবং সমস্ত প্রাণীদের মধ্যে আমি চেতনা।
শ্লোক:23:
রুদ্রাণাং শঙ্করশ্চাস্মি বিত্তেশো যক্ষরক্ষসাম্ ।
বসূনাং পাবকশ্চাস্মি মেরুঃ শিখরিণামহম্ ॥২৩॥
শব্দার্থঃ রুদ্রাণাম্ - রূদ্রদের মধ্যে; শঙ্করঃ — শিব; চ – ও; অস্মি - হই; বিত্তেশঃ - কুবের, যক্ষরক্ষসাম্ - যক্ষ ও রাক্ষসদের মধ্যে, বসুনাম্— বসুদের মধ্যে, পাবকঃ - অগ্নি, চ – ও, অস্মি — হই, মেরুঃ– মেরু; শিখরিণাম - পর্বতসমূহের মধ্যে; অহম্—আমি।
অনুবাদ:- রুদ্রদ্রের মধ্যে আমি শিব, যক্ষ ও রাক্ষসদের মধ্যে আমি কুবের, বসুদের মধ্যে আমি অগ্নি এবং সমস্ত পর্বতসমূহের মধ্যে আমি সুমেরু।
শ্লোক:24:
পুরোধসাং চ মুখ্যং মাং বিদ্ধি পার্থ বৃহস্পতিম্ ।
সেনানীনামহং স্কন্দঃ সরসামস্মি সাগরঃ ॥২৪॥
শব্দার্থঃ পুরোধসাম্—পুরোহিতদের মধ্যে; চ–ও, মুখ্যম্-প্রধান; মাম্— আমাকে; বিদ্ধি— জানবে; পার্থ – হে পৃথাপুত্র: বৃহস্পতিম্—বৃহস্পতি; সেনানীনাম্—সেনাপতিদের মধ্যে; অহম্ - আমি, স্বন্দঃ - কার্তিকেয়; সরসাম্—সমস্ত জলাশয়ের মধ্যে; অস্মি -হই; সাগরঃ — সাগর।
অনুবাদ:- হে পার্থ ! পুরোহিতদের মধ্যে আমি প্রধান বৃহস্পতি, সেনাপতিদের মধ্যে আমি কার্তিক এবং জলাশয়ের মধ্যে আমি সাগর।
শ্লোক:25:
মহর্ষীণাং ভৃগুরহং গিরামস্ম্যেকমক্ষরম্ ।
যজ্ঞানাং জপযজ্ঞোহস্মি স্থাবরাণাং হিমালয়ঃ ॥২৫॥
শব্দার্থঃ মহর্ষীণাম্—মহর্ষিদের মধ্যে; ভৃগুঃ– ভৃগু; অহম্ — আমি; গিরাম—বাক্যসমূহের মধ্যে: অম্মি—হই; একম্ অক্ষরম – এক অক্ষর প্রণব; যজ্ঞানাম্— যজ্ঞসমূহের মধ্যে, জপযজ্ঞঃ—জপযজ্ঞ; অস্মি—হই; স্থাবরাণাম্–স্থাবর বস্তুসমূহের মধ্যে; হিমালয়ঃ —হিমালয় পর্বত।
অনুবাদ:- মহর্ষিদের মধ্যে আমি ভৃগু, বাক্য সমূহের মধ্যে আমি ওঁকার৷ যজ্ঞসমূহের মধ্যে আমি জপযজ্ঞ এবং স্থাবর বস্তুসমূহের মধ্যে আমি হিমালয়।
শ্লোক:26:
অশ্বথঃ সর্ববৃক্ষাণাং দেবর্ষীণাং চ নারদঃ ।
গন্ধর্বাণাং চিত্ররথঃ সিদ্ধানাং কপিলো মুনিঃ ॥২৬॥
শব্দার্থঃ অশ্বত্থঃ—অশ্বত্থ বৃক্ষ; সর্ববৃক্ষাণাম্— সমস্ত বৃক্ষের মধ্যে, দেবর্ষীণাম্-দেবর্ষিদের মধ্যে; চ–এবং; নারদঃ নারদ মুনি; গন্ধর্বাণাম্—গন্ধবদের মধ্যে; চিত্ররথঃ— চিত্ররথ, সিদ্ধানাম্ — সিদ্ধদের মধ্যে; কপিলঃ মুনিঃ—কপিল মুনি।
অনুবাদ:- সমস্ত বৃক্ষের মধ্যে আমি অশ্বথ, দেবর্ষিদের মধ্যে আমি নারদ৷ গন্ধর্বদের মধ্যে আমি চিত্ররথ এবং সিদ্ধদের মধ্যে আমি কপিল মুনি।
শ্লোক:27:
উচ্চৈঃশ্রবসমশ্বানাং বিদ্ধি মামমৃতোদ্ ভবম্ ।
ঐরাবতং গজেন্দ্রাণাং নরাণাং চ নরাধিপম্ ॥২৭॥
শব্দার্থঃ উচ্চৈঃশ্রবসম্—উচ্চৈঃশ্রবা; অশ্বানাম্ অশ্বদের মধ্যে; বিদ্ধি—জানবে, মাম্ আমাকে: অমৃতোদ্ভবম্— সমুদ্র মন্থনের সময় উদ্ভূত; ঐরাবতম্ — ঐরাবত, গজেন্দ্রাণাম্—শ্রেষ্ঠ হস্তিদের মধ্যে; নরাণাম— মানুষদের মধ্যে; চ–এবং, নরাধিপম্— রাজা।
অনুবাদ:- অশ্বদের মধ্যে আমাকে সমুদ্র-মন্থনের সময় উদ্ভূত উচ্চৈঃশ্রবা বলে জানবে৷ শ্রেষ্ঠ হস্তীদের মধ্যে আমি ঐরাবত এবং মনুষ্যদের মধ্যে আমি সম্রাট।
শ্লোক:28:
আয়ুধানামহং বজ্রং ধেনূনামস্মি কামধুক্ ।
প্রজনশ্চাস্মি কন্দর্পঃ সর্পাণামস্মি বাসুকীঃ ॥২৮॥
শব্দার্থঃ আয়ুধানাম্—সমস্ত অস্ত্রের মধ্যে; অহম্ - আমি; বজ্রম্ - বজ্র; ধেনুনাম্—গাভীদের মধ্যে; অস্মি—হই; কামধুক্ – কামধেনু, প্রজনঃ— সন্তান উৎপাদনের কারণ, চ– এবং; অম্মি—হই; কন্দর্পঃ- কামদেব, সর্পাণাম—সর্পদের মধ্যে; অস্মি–হই; বাসুকীঃ — বাসুকি।
অনুবাদ:- সমস্ত অস্ত্রের মধ্যে আমি বজ্র, গাভীদের মধ্যে আমি কামধেনু৷ সন্তান উৎপাদনের কারণ আমিই কামদেব এবং সর্পদের মধ্যে আমি বাসুকি।
শ্লোক:29:
অনন্তশ্চাস্মি নাগানাং বরুণো যাদসামহম্ ।
পিতৃণামর্যমা চাস্মি যমঃ সংযমতামহম্ ॥২৯॥
শব্দার্থঃ অনন্তঃ — অনন্ত, চ–ও; অস্মি— হই; নাগানাম্ - নাগদের মধ্যে; বরুণঃ–বরুণদেব; যাদসাম—সমস্ত জলচরের মধ্যে, অহম্ —আমি; পিতৃণাম পিতৃদের মধ্যে, অর্যমা—অর্যমা; চ–ও; অস্মি—হই, যমঃ - যমরাজ, সংযমতাম্ দণ্ডদাতাদের মধ্যে; অহম্—আমি।
অনুবাদঃ সমস্ত নাগদের মধ্যে আমি অনন্ত এবং জলচরদের মধ্যে আমি বরুণ৷ পিতৃদের মধ্যে আমি অর্যমা এবং দণ্ডদাতাদের মধ্যে আমি যম।
শ্লোক:30:
প্রহ্লাদশ্চাস্মি দৈত্যানাং কালঃ কলয়তামহম্ ।
মৃগাণাং চ মৃগেন্দ্রোহহং বৈনতেয়শ্চ পক্ষিণাম্ ॥৩০॥
শব্দার্থঃ প্রহ্লাদঃ—প্ৰহ্লাদ; চ–ও; অস্মি—হই; দৈত্যানাম্ – দৈত্যদের মধ্যে, কালঃ - কাল, কলয়তাম্ - বশীকারীদের মধ্যে, অহম্—আমি। মৃগাণাম্—সমস্ত পশুদের, চ–এবং; মৃগেন্দ্রঃ—সিংহ; অহম্ – আমি; বৈনতেয়ঃ—গরুড়; চ—এবং, পক্ষিণাম্ - পক্ষীদের মধ্যে।
অনুবাদ:- দৈত্যদের মধ্যে আমি প্রহ্লাদ, বশীকারীদের মধ্যে আমি কাল, পশুদের মধ্যেআমি সিংহ এবং পক্ষীদের মধ্যে আমি গরুড়।
শ্লোক:31:
পবনঃ পবতামস্মি রামঃ শস্ত্রভৃতামহম্ ।
ঝষাণাং মকরশ্চাস্মি স্রোতসামস্মি জাহ্নবী॥৩১॥
শব্দার্থঃ পবনঃ—বায়ু, পবতাম্—পবিত্রকারীদের মধ্যে, অস্মি - হই, রামঃ - পরশুরাম, শস্ত্রভৃতাম্—শস্ত্রধারীদের মধ্যে; অহম্—আমি; ঝষাণাম্—মৎস্যদের মধ্যে; মকরঃ —মকর; চ — ও, অস্মি— হই; স্রোতসাম—নদীসমূহের মধ্যে; অস্মি — হই; জাহ্নবী–গঙ্গা।
অনুবাদ:- পবিত্রকারী বস্তুদের মধ্যে আমি বায়ু, শস্ত্রধারীদের মধ্যে আমি পরশুরাম, মৎস্যদের মধ্যে আমি মকর এবং নদীসমূহের মধ্যে আমি গঙ্গা।
শ্লোক:32:
সর্গাণামাদিরন্তশ্চ মধ্যং চৈবাহমর্জুন ।
আধ্যাত্মবিদ্যা বিদ্যানাং বাদঃ প্রবদতামহম্ ॥৩২॥
শব্দার্থঃ সর্গাণাম্ – সৃষ্ট বস্তুর মধ্যে, আদিঃ—আদি, অন্তঃ— অন্ত; চ–এবং; মধ্যম – মধ্য, চ–ও; এব–অবশ্যই, অহম্ - আমি; অর্জুন – হে অর্জুন, অধ্যাত্মবিদ্যা – চিন্ময় জ্ঞান; বিদ্যানাম্—সমস্ত বিদ্যার মধ্যে; বাদঃ — সিদ্ধান্তবাদ; প্রবদতাম্ - তার্কিকদের বাদ, জন্ম ও বিতণ্ডার মধ্যে, অহম্ – আমি।
অনুবাদ:- হে অর্জুন ! সমস্ত সৃষ্ট বস্তুর মধ্যে আমি আদি, অন্ত ও মধ্য৷ সমস্ত বিদ্যার মধ্যে আমি অধ্যাত্মবিদ্যা এবং তার্কিকদের বাদ, জল্প ও বিতণ্ডার মধ্যে আমি সিন্ধান্তবাদ।
শ্লোক:33:
অক্ষরাণামকারোহস্মি দ্বন্দ্বঃ সামাসিকস্য চ।
অহমেবাক্ষয়ঃ কালো ধাতাহং বিশ্বতোমুখঃ ॥৩৩॥
শব্দার্থঃ অক্ষরাণাম্—সমস্ত অক্ষরের মধ্যে, অকারঃ– অকার; অস্মি— হই; দ্বন্দ্বঃ — দ্বন্দ্ব, সামাসিকস্য - সমাসসমূহের মধ্যে চ–এবং, অহম্ — আমি; এব—অবশ্যই, অক্ষয়ঃ—নিত্য; কালঃ—কাল; ধাতা— স্ৰষ্টা; অহম্ — আমি, বিশ্বতোমুখঃ - ব্রহ্মা।
অনুবাদ:- সমস্ত অক্ষরের মধ্যে আমি অকার, সমাসসমূহের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সমাস,সংহারকারীদের মধ্যে আমি মহাকাল রুদ্র এবং স্রষ্টাদের মধ্যে আমি ব্রহ্মা।
শ্লোক:34:
মৃত্যুঃ সর্বহরশ্চাহমুদ্ভবশ্চ ভবিষ্যতাম্ ।
কীর্তিঃ শ্রীর্বাক্ চ নারীণাং স্মৃতির্মেধা ধৃতিঃ ক্ষমা ॥৩৪॥
শব্দার্থঃ মৃত্যুঃ — মৃত্যু; সর্বহরঃ—সমস্ত হরণকারীদের মধ্যে; চ–ও; অহম্ - আমি; উদ্ভবঃ — উদ্ভব; চ–ও; ভবিষ্যতাম্ – ভবিষ্যতের, কীর্তিঃ—কীর্তি, শ্রীঃ—ঐশ্বর্য অথবা সৌন্দৰ্য; বাক্—বাণী: চ–ও; নারীণাম্ - নারীদের মধ্যে; স্মৃতিঃ—স্মৃতি, মেধা - মেধা; ধৃতিঃ—ধৃতি; ক্ষমা—ক্ষমা।
অনুবাদ:- সমস্ত হরণকারীদের মধ্যে আমি সর্বগ্রাসী মৃত্যু, ভাবীকালের বস্তুসমূহের মধ্যে আমি উদ্ভব৷ নারীদের মধ্যে আমি কীর্তি, শ্রী, বাণী, স্মৃতি, মেধা, ধৃতি ও ক্ষমা।
শ্লোক:35:
বৃহৎসাম তথা সাম্নাং গায়ত্রী ছন্দসামহম্ ।
মাসানাং মার্গশীর্ষোহহ্ মৃতূনাং কুসুমাকরঃ ॥৩৫॥
শব্দার্থঃ বৃহৎসাম্ – বৃহৎসাম; তথা — ও সাম্নাম্–সামবেদের মধ্যে গায়ত্রী—গায়ত্রী মন্ত্র, ছন্দসাম্ফন্দসমূহের মধ্যে অহম্ – আমি; মাসানাম— মাসসমূহের মধ্যে; মার্গশীর্ষ —অগ্রহায়ণ; অহম্—আমি; ঋতুনাম—সমস্ত ঋতুর মধ্যে, কুসুমাকরঃ—বসন্ত।
অনুবাদ:- সামবেদের মধ্যে আমি বৃহৎসাম এবং ছন্দসমূহের মধ্যে আমি গায়ত্রী, মাসসমূহের মধ্যে আমি অগ্রহায়ণ এবং ঋতুদের মধ্যে আমি বসন্ত।
শ্লোক:36:
দ্যুতং ছলয়তামস্মি তেজস্তেজস্বিনামহম্ ।
জয়োহস্মি ব্যবসায়োহস্মি সত্ত্বং সত্ত্ববতামহম্॥৩৬॥
শব্দার্থঃ দ্যূতম্—দ্যূতক্রীড়া; ছলয়তাম্— বঞ্চনাকারীদের মধ্যে; অস্মি— হই; তেজঃ—তেজ, তেজস্বিনাম্—তেজস্বীদের মধ্যে; অহম্ — আমি; জয়ঃ— জয়; অস্মি— হই ব্যবসায়ঃ —উদ্যম; অস্মি—হই; সত্ত্বম্ - বল; সত্ত্ববতাম্ - বলবানদের মধ্যে; অহম্— আমি।
অনুবাদ:- সমস্ত বঞ্চনাকারীদের মধ্যে আমি দ্যূতক্রীড়া এবং তেজস্বীদের মধ্যে আমি তেজ। আমি বিজয়, আমি উদ্যম এবং বলবানদের মধ্যে আমি বল।
শ্লোক:37:
বৃঞ্চীনাং বাসুদেবোহস্মি পাণ্ডবানাং ধনঞ্জয়ঃ ।
মুনীনামপ্যহং ব্যাসঃ কবীনামুশনাঃ কবিঃ॥৩৭॥
শব্দার্থঃ বৃষ্ণীনাম্ - বৃষ্ণিদের মধ্যে; বাসুদেবঃ - দ্বারকাধীশ শ্রীকৃষ্ণ; অস্মি—হই; পাণ্ডবানাম্—পাণ্ডবদের মধ্যে, ধনঞ্জয়ঃ—অর্জুন; মুনীনাম্—মুনীদের মধ্যে; অপি— ও; অহম্ – আমি, ব্যাসঃ - ব্যাসদেব, কবীনাম্ - মহান চিন্তাশীল ব্যক্তিদের মধ্যে, উশনাঃ — শুক্র; কবিঃ—কবি।
অনুবাদ:- বৃঞ্চিদের মধ্যে আমি বাসুদেব এবং পাণ্ডবদের মধ্যে আমি অর্জুন ৷ মুনিদের মধ্যে আমি ব্যাস এবং কবিদের মধ্যে আমি শুক্রাচার্য।
শ্লোক:38:
দণ্ডো দময়তামস্মি নীতিরস্মি জিগীষতাম্ ।
মৌনং চৈবাস্মি গুহ্যানাং জ্ঞানং জ্ঞানবতামহম্ ॥৩৮॥
শব্দার্থঃ দণ্ডঃ—দণ্ড, দময়তাম্—দমনকারীদের মধ্যে; অস্মি— হই; নীতিঃ—নীতি; অস্মি— হই; জিগীষতাম্ — জয় অভিলাষকারীদের; মৌনম্— মৌন; চ–এবং; এব—ও; অশ্মি হই; গুহ্যানাম্ - গোপনীয় বিষয় সমূহের মধ্যে, জ্ঞানম্ – জ্ঞান; জ্ঞানবতাম্—জ্ঞানবানদের মধ্যে; অহম্ — আমি।
অনুবাদ:- দমনকরীদের মধ্যে আমি দণ্ড এবং জয় অভিলাষীদের মধ্যে আমি নীতি৷ গুহ্য ধর্মের মধ্যে আমি মৌন এবং জ্ঞানবানদের মধ্যে আমিই জ্ঞান।
শ্লোক:39:
যচ্চাপি সর্বভূতানাং বীজং তদহমর্জুন ।
ন তদস্তি বিনা যৎ স্যান্ময়া ভূতং চরাচরম্ ॥৩৯॥
শব্দার্থঃ যৎ—যা; চ–ও; অপি- হতে পারে; সর্বভূতানাম্ - সর্বভূতের; বীজম্ - বীজ; তৎ—তা; অহম্—আমি; অর্জুন – হে অর্জুন, ন-না; তৎ—তা; অস্তি— হয়; বিনা - ব্যতীত, যত্—যা; স্যাৎ — অস্তিত্ব, ময়া—আমাকে; ভূতম্ - বস্তু; চরাচরম্ স্থাবর ও জঙ্গম।
অনুবাদ:- হে অর্জুন! যা সর্বভূতের বীজস্বরূপ তাও আমি, যেহেতু আমাকে ছাড়া স্থাবর ও জঙ্গম কোন বস্তুরই অস্তিত্ত্ব থাকতে পারে না।
শ্লোক:40:
নান্তোহস্তি মম দিব্যানাং ,বিভূতীনাং পরন্তপ ।
এষ তূদ্দেশতঃ প্রোক্তো বিভূতের্বিস্তরো ময়া ॥৪০॥
শব্দার্থঃ ন—না; অন্তঃ—সীমা; অস্তি— হয়; মম—আমার; দিব্যানাম্—দিব্য; বিভূতীনাম্ বিভূতি-সমূহের; পরন্তপঃ — হে পরন্তপ; এবঃ – এই সমত; তু–কিন্তু; উদ্দেশতঃ —সংক্ষেপে, প্রোক্তঃ - বলা হল; বিভূতেঃ—বিভূতির; বিস্তরঃ —বিস্তার; ময়া - আমার দ্বারা।
অনুবাদ:- হে পরন্তপ! আমার দিব্য বিভুতি-সমূহের অন্ত নেই৷ আমি কেবল এই সমস্ত বিভূতির বিস্তার সংক্ষেপে বললাম।
শ্লোক:41:
যদ্ যদ্বিভূতীমৎ সত্ত্বং শ্রীমদূর্জিতমেব বা ।
তত্তদেবাবগচ্ছ ত্বং মম তেজোহংশসম্ভবম্॥৪১॥
শব্দার্থঃ যৎ যৎ— যে যে; বিভূতিমত্—ঐশ্বর্যযুক্ত, সত্ত্বম— অস্তিত্ব, শ্রীমৎ—সুন্দর; - ; ঊর্জিতম— মহিমান্বিত; এৰ– অবশ্যই; বা–অথবা। তৎ তৎ—সেই সমস্ত; এব—অবশ্যই, অবগচ্ছ - অবগত হও; ত্বম্– তুমি; মম— আমার; তেজঃ—তেজের, অংশ—অংশ; সম্ভবম্–সম্ভূত।
অনুবাদ:- ঐশ্বর্য্যযুক্ত, শ্রী-সম্পন্ন ও বল-প্রভাবাদির আধিক্যযুক্ত যত বস্তু আছে, সে সবই আমার তেজাংশসম্ভূত বলে জানবে।
শ্লোক:42:
অথবা বহুনৈতেন কিং জ্ঞাতেন তবার্জুন।
বিষ্টভ্যাহমিদং কৃৎস্নমেকাংশেন স্থিতো জগৎ ॥৪২॥
শব্দার্থঃ অথবা — অথবা; বহুনা—বহু, এতেন—এই প্রকার; কিম্—কি; জ্ঞাতেন— জ্ঞান, তব–তোমার; অর্জুন—হে অর্জুন। বিষ্টভ্য—ব্যাপ্ত হয়ে; অহম্ – আমি, ইদম্ - এই; কৃৎস্নম্—সমগ্র; এক— এক; অংশেন—অংশের দ্বারা; স্থিতঃ — অবস্থিত, জগৎ - জগৎ।
অনুবাদ:- হে অর্জুন! অথবা এই প্রকার বহু জ্ঞানের দ্বারা তোমার কি প্রয়োজন? আমি আমার এক অংশের দ্বারা সমস্ত জগতে ব্যাপ্ত হয়ে অবস্থিত আছি।
ওঁ তৎসদিতি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসূপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে
শ্রীকৃষ্ণার্জুনসংবাদে 'বিভূতিযোগো' নামক দশমোঽধ্যায়ঃ সমাপ্তম্।
Post a Comment